মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জের দুই বরেণ্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক এমপি মরহুম অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী ও সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর নাম স্বাধীনতা পদকের জন্য প্রস্তাবাকারে প্রেরণ করা হয়েছে। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তাদের দুই জনের নাম প্রস্তাব করে ৩০ কপি আবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান।
মঙ্গলবার বিকেলে ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে মহান বিজয় দিবসের প্রস্তুতি সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ এমপি হবিগঞ্জে আসলে এক সভায় মরহুম অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলীকে স্বাধীনতা পদকের জন্য নাম প্রেরণের প্রস্তাব করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির। হবিগঞ্জ-২ আসনের এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মরহুম অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলীর নামের পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর নাম প্রস্তাব আকারে প্রেরণ করা হয়েছে।
অ্যাডভোকেট মরহুম মোস্তফা আলী হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়িয়াউক গ্রামে ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে আইএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বিএ পাশ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে হবিগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সাল থেকে হবিগঞ্জ মহকুমার আজীবন সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে হবিগঞ্জ সদর-লাখাই-মাধবপুর আসন থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে হবিগঞ্জ মহকুমায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি আহবায়ক হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর শায়েস্তানগর বাসা ছিল সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়। পাকিস্তান আর্মি ও রাজাকার বাহিনী তার বাসা অগ্নি সংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের উপ আঞ্চলিক প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন পূর্বাঞ্চল প্রশাসনিক পরিষদের সদস্য এবং মেথালীর ক্যাম্প চীফ। ১৯৭১ সালে সর্ব প্রথম পূর্বাঞ্চলের শরণার্থীদের সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ব্রিফিং দেন অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রাজাকারদের সাথে কোন আপোষ করেননি। রাজাকারদের বিচারের দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার। হবিগঞ্জ মহকুমায় রাজাকারদের বিচারের দাবিতে তিনি বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী ছিলেন হবিগঞ্জ মহকুমা রেডক্রসের চেয়ারম্যান, হবিগঞ্জ সমাজকল্যাণ বিভাগের চেয়ারম্যান, হবিগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তিন বার নির্বাচিত সভাপতি, হবিগঞ্জ সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাংকের চেয়ারম্যান, হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচিত সভাপতি, শায়েস্তাগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম সদস্য। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ সদর- লাখাই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ১৯ জুলাই হবিগঞ্জ মহকুমার গভর্ণর হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলীর নাম ঘোষণা করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুলাই অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী ঢাকায় এমপি হোস্টেলে মৃত্যুবরণ করেন।
দেওয়ান ফরিদ গাজী হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসন থেকে ৩ বার এবং সিলেট সদর আসন থেকে ২ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালের ১ মার্চ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর পরগনার দেবপাড়া গ্রামে দেওয়ান ফরিদ গাজী জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে কুইট-ইন্ডিয়া বা ভারত ছাড় তথা বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের মাধ্যমে ফরিদগাজী ভারতীয় কংগ্রেসের অঙ্গসংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস কংগ্রেস‘ এর সাথে ছাত্র রাজনীতিতে যোগদেন। পরবর্তীতে মুসলিম লীগের অংগসংগঠন ‘আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশান’ গঠিত হলে তিনি এ সংগঠনের আসাম প্রাদেশিক শাখার এজিএস এবং এমসি কলেজ শাখার জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার আসাম হতে বাঙ্গালীদের উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলে তখন তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আহবানে আসামের নওগাতে ছুটে গিয়ে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। ১৯৪৬ সালে নবাবজাদা রিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী খালেকুজ্জামানের উপস্থিতিতে আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের বিশেষ কাউন্সিলে বৃহত্তর সিলেটের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে হিন্দু সমর্থিত কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট সিলেটের নয়াসড়ক জামে মসজিদে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সাথে মুসলিম সমর্থিত সিলেটের সংগ্রামী মুসলিম ছাত্রজনতার এক সংঘর্ষে দেওয়ান ফরিদ গাজী মারাত্মক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। বৃটিশ বিরোধী আন্দেলনের শেষ পর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে সিলেট ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে বৃটিশ পতাকা নামিয়ে দেয় সিলেটের ছাত্রজনতা। আসাম রেফারেন্ডামে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি সিলেটের মাটিতে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ঢাকার পরই সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয় সিলেটে। যার নেতৃত্বে ছিলেন দেওয়ান ফরিদগাজী। তিনি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামেও সিলেটে নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বেই সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন।
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট সদর আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সিলেট সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তিনি হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা ও প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সিলেট ডেপুটি কমিশনারে কার্যালয় থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে পুড়ে ফেলেন এবং ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেট ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশের পতাকা উত্তোলন করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দেলন সহ দেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি নেতৃত্ব দেন।
দেওয়ান ফরিদ গাজী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। স্বাধীনতার পর দেওয়ান ফরিদ গাজী বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।