জালাল আহমেদ
সকাল সাতটায় ঘুম থেকে বারান্দায় এসে দেখতাম জেলা প্রশাসক ফুললি ড্রেসড, পায়চারী করে ধুমপান করছেন

খাগড়াছড়ি শহরে তখনো গ্রীডলাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না, সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল জেনারেটর নির্ভর, সময়ানুগ, সকাল ৭টা থেকে রাত ১২টা। আমি রাত পৌণে বারটায় ক্যাসেট প্লেয়ারে (এখন কেউ চেনে না!) জগজিৎ-চিত্রা’র ক্যাসেট ঢুকিয়ে শুয়ে পড়তাম। ১৫ মিনিট গান শুনিয়ে প্লেয়ার যেতো থেমে। সকাল সাতটায় আবার বেজে উঠতো আর আমিও ঘুম থেকে উঠতাম। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে ব্রাশ করতে করতে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখতাম জেলা প্রশাসক মহোদয় ফুললি ড্রেসড, পায়চারী করে ধুমপান করছেন। তাঁকে যে তিন মাস দেখেছি, একই রুটিন। পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম সকাল সাতটায় রেডি হয়ে যাবার কারণ কী? তিনি বলেছিলেন সাতটায় রেডি হয়ে থাকলে ‘ইউ গেট এক্সট্রা টু আওয়ারস!’ যেটা সঠিক। মাইজুদ্দিন আহমেদ, ১৯৭৩ সালে ঝালকাঠি যখন মহকুমা হয়, তখন এর প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। আবার ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ির প্রথম জেলা প্রশাসকও হলেন। মাঝখানের ৯/১০ বছর তিনি ৪ জন উপদেষ্টা/মন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। বিখ্যাত আত্মজীবনী “আন্ডার দ্য থ্রি ফ্ল্যাগস” এর লেখক কাজী আনোয়ারুল হকের একান্ত সচিব ছিলেন ৬ বছর। কাজী আনোয়ারুল হক ১৯৩৩ সালের আইপিএস, ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের আইজি ছিলেন, ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী ছিলেন, সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, ১৯৬৫ সাল থেকে ৪ বছর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ পরবর্তী ৬ বছর তিনি সায়েম-জিয়া-সাত্তার ক্যাবিনেটে উপদেষ্টা ও মন্ত্রী ছিলেন। ফলে মাইজুদ্দিন সাহেব এই অভ্যাস নিজের জন্য গড়ে তুলেছিলেন যা অনুসরণীয়। আমি সাধারণত দিনে ঘুমাই না, ১৯৭৮ থেকে। এর ভিত্তি একটি সাক্ষাৎকার। আমাদের প্রজন্ম চিত্রপরিচালক আব্দুস সামাদকে চেনে, অভিনেত্রী রোজি সামাদ তাঁর স্ত্রী ছিলেন। জনাব সামাদের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম তখন ইত্তেফাকে। যেখানে তিনি বলেছিলেন যে আমার আয়ু যদি ৬০ বছর হয় আর আমি দিনে ৬ ঘন্টা ঘুমাই তবে ১৫ বছর কেটে যাবে ঘুমে। আর ৮ ঘন্টা ঘুমালে ২০ বছর। তাই আমরা যদি আমাদের দেহঘড়িকে বুঝতে পারি এবং সে অনুযায়ী ঘুমাই, তবেই আমাদের দৈনন্দিন সময় অনেক বেড়ে যেতে পারে।
১৯৮৩ এর নভেম্বরের ৬ তারিখে এসে যোগদান করলেন ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের সদ্যপ্রয়াত শামসুল কিবরিয়া চৌধুরী ও এ এন হাফেজ আহমেদ। জেলা উদ্বোধন উপলক্ষে এনডিসি হিসেবে আমার অন্যতম চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা করা। খাগড়াছড়িতে চিৎ-কাইত ছাড়া কোন হোটেল ছিল না। তিন বছর আগে যে মহকুমার জন্ম সেখানে তেমন কোন বিভাগীয় রেস্টহাউজও নেই। তাই ফার্নিচারের দোকান থেকে আবাসনগুলোতে খাট/চৌকি এনে সেগুলোকে রেস্টহাউজে রুপান্তরের কাজ শুরু করলাম। সদর সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) আশরাফুল আলমও আমাদের এই কাজে সহায়তা করলেন। এরমাঝে আমার এক প্রিয় বস, সাবেক সিএসপি’র ফরমায়েস ছিল যে বিছানা হতে হবে ফুল কটন এবং মশারী হবে সুক্ষ। আমাদের নিজেদের অফিসারদের জন্যও ‘ইম্প্রোভাইজড’ আবাসনের ব্যবস্থা করা হলো। ৭ নভেম্বর সকালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এলেন দুটি হেলিকপ্টার নিয়ে। তিনি একটাতে, নামলেন ব্রিগেড হেলিপ্যাডে। সেখান থেকে মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে মহকুমা প্রশাসকের অফিস প্রাঙ্গণে। জেলা প্রশাসক রাঙ্গামাটি বা বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রাম, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী আসেননি। আমার ধারনা সিএমএলএ’র প্রোগ্রাম বলেই আসেননি, এখনকার সময় হলে কি হতো জানি না। তখনকার অন্ততঃ একটি ঘটনা আমার এভাবে জানা আছে যে এক জিওসি একজন বিভাগীয় কমিশনার এর পিঠে হাত রেখে কথা বলেছিলেন বলে তিনি চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিলেন। রাঙ্গামাটি থেকে এসেছিলেন এডিসি শফিকুল ইসলাম আর চট্টগ্রাম থেকে অতিরিক্ত কমিশনার আলী হায়দার খান, জিওসি মেজর জেনারেল আব্দুল মান্নাফ।
মহকুমা প্রশাসক অফিস প্রাঙ্গণে জেলা উদ্বোধন ফলক উন্মোচন করা হলো। এরপর প্যান্ডেলে বসে নেশন ওয়াইড ডায়ালিং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ উদ্বোধন করলেন। এখানে ভিড় ছিল না কারণ অফিসাররা সবাই ছিল সিএইচটিডিবি রেস্টহাউসে আর জনগণ স্কুল মাঠে। এক্সচেঞ্জ উদ্বোধন করে তিনি আসলেন নতুন কুঁড়ি কিশলয় স্কুল প্রাঙ্গণে, স্কুল উদ্বোধন করলেন। স্কুলটি এখনো খাগড়াছড়ি শহরে চালু রয়েছে। এরপর সিএইচটিডিবি রেস্টহাউজে অফিসারদের সঙ্গে পরিচিত হলেন, ব্রিফড হলেন ও মিটিং করে লাঞ্চ করলেন। লাঞ্চ এর পর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভায় ভাষন দিলেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের বিদায়ের পর স্কুল মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় শিল্পীদের ছোট্ট পরিবেশনা এবং তারপর তখনকার বিখ্যাত ব্যান্ড, চট্টগ্রামের সোলস এক ঘন্টার উপর মাঠ মাতিয়ে রাখলো। তখন সোলসের ওল্ড হ্যান্ডস সবাই আছে। জেলা প্রশাসক জেলা উদ্বোধনের আগে থেকেই মহকুমা প্রশাসকের রুমে বসে অফিস করতে শুরু করেন। আগেই সিদ্ধান্ত ছিল যে নতুন জেলা প্রশাসনের অফিস এবং জেলা প্রশাসকের বাসার জন্য সরকারী প্রাপ্যতা অনুযায়ী কার্পেট ও ম্যাট কিনতে হবে। সহজ উৎস হলো সরকারী প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি’র আমিন জুট মিলস, চট্টগ্রাম। নতুন জেলা, গাড়ি নেই বলে মাটিরাঙ্গা’র ইউএনও সাহেবের গাড়ি নিয়ে যাব। তাই ইউএনও সাহেবের সংগে কথা হলো যে পথ এগিয়ে রাতে গিয়ে মাটিরাঙ্গা থাকবো, সেখান থেকে সকালে চট্টগ্রাম যাবো। এতে সকালে আর গাড়িকে মাটিরাঙ্গা থেকে উল্টো পথে জেলা সদরে আসতে হল না, সময় বাঁচলো সঙ্গে জ্বালানীও।