লাখাইয়ে টমটম চালকের লাশ উদ্ধারের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ॥ আদালতে দুই ঘাতকের স্বীকারোক্তি
এসএম সুরুজ আলী/সুমন আহমেদ বিজয় ॥ লাখাই উপজেলার তিস্কারপুর এলাকা থেকে টমটম চালক ফালু মিয়ার লাশ উদ্ধারের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত ২ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গতকাল তারা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান উদ্দিন প্রধান এর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। জবানবন্দিতে গ্রেফতারকৃত জানায়, টমটম ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে মুড়ি ও ছানাচুরের সাথে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে অজ্ঞান করে রশি গলায় প্যাঁচিয়ে টমটম চালক ফালু মিয়াকে হত্যা করে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০ মার্চ তিস্কারপুর এলাকা অজ্ঞাত লাশের খবর পেয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম) নির্দেশে এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলাম (পিপিএম-সেবা) নেতৃত্বে লাখাই থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ সাইদুল ইসলামসহ পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে পুলিশ নিশ্চিত হয় লাশটি হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানাধীন ইসলামাবাদ এলাকার শুক্কুর আলীর পুত্র ফালু মিয়ার। সে পেশায় একজন টমটম চালক। পরবর্তীতে পুলিশ তার সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করে। সুরতহাল রিপোর্টে নিহতের গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী শেষে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের মর্গে নিহতের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। ময়না তদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী পুলিশ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয় রশি গলায় প্যাঁচিয়ে ফালু মিয়াকে হত্যা করেছে ঘাতকরা। এ ব্যাপারে এসআই মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বাদী হয়ে এ ঘটনায় অজ্ঞাত আসামীদের বিরুদ্ধে লাখাই থানায় হত্যা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর এএসআই মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন ও এএসআই তোহাসহ পুলিশের একটি টিম হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করার কাজ শুরু করে এবং হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে হবিগঞ্জ সার্কেল এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলারেম নেতৃত্বে পুলিশ অভিযান চালিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার শিবলা গ্রামের মৃত ছাত্তার মিয়ার ছেলে রাসেল মিয়া (২৫) ও বি-বাড়িয়া সদর উপজেলার চান্দিয়ারা গ্রামের মৃত জালাল মিয়া ইসলাম মিয়াকে (৩৫) গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ফালু মিয়াকে হত্যার লোহমর্ষক, চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। তারা জানায় ১৯ মার্চ রাত ৮টার দিকে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক জসিম ও রাসেল মিয়া নামে দুই ব্যক্তি ফালু মিয়ার টমটম ছিনতাই করার উদ্দেশ্যে কৌশলে টমটমটি ভাড়া করে এবং ফালু মিয়াসহ টমটমটি লাখাই থানার মোড়াকড়ি এলাকায় নিয়ে আসে। মোড়াকড়ি এলাকায় আসার পর আসামীরা মুড়ি ও ছানাচুরের সাথে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে ফালু মিয়াকে খাওয়ায়। নেশাযুক্ত মুড়ি ছানাচুর খাওয়ার পর ফালু মিয়া অচেতন হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে রাসেল মিয়া ফালু মিয়া’কে নিয়ে টমটমের পিছনে বসে এবং ঘটনায় জড়িত জসিম টমটমটি চালিয়ে তিস্কারপুর এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর আসামীরা টমটমটি রাস্তার পাশে রেখে ফালু মিয়াকে নিয়ে শুকনা খালের মধ্যে নামে এবং সেখানে থাকা একটি গাছের উপর ফালু মিয়াকে বসায়। গাছের উপরে ফালু মিয়াকে বসানোর পর রাসেল মিয়া তাকে ধরে রাখে এবং জসিম তাৎক্ষনিক টমটম হতে একটি নাইলনের রশি নিয়ে আসে। নাইলনের রশি আনার পর রাসেল মিয়া অচেতন ফালু মিয়া’কে মাটির ওপর উপুড় করে বসিয়ে তার হাত-পা একত্রিত করে চেপে ধরে এবং জসিম মিয়া নাইলনের রশি ফালু মিয়ার গলায় পেঁছিয়ে শ^াসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। ফালু মিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর ঘাতকরা দ্রুত টমটমটি নিয়ে নখলাউক ও কাশিমপুর হয়ে বুল্লা বাজারে যাওয়ার পর টমটমের চার্জ শেষ হয়ে যায়। তখন ঘাতকরা সেখানে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সকাল হওয়ার পর তারা অন্য আরেকটি টমটম ভাড়া করে সেটা দিয়ে টমটমটি ভাদিকারা এলাকায় নিয়ে আসে। ভাদিকারা পৌঁছার পর স্থানীয় লোকজনের টমটমটি দেখার পর সন্দেহ হলে তারা টমটমটি আটক করেন। গত ২০ মার্চ ঘাতকরা এলাকার লোকজনদের সাথে সুকৌশলে আলাপ আলোচনা করে টমটমটি তাদের বলে দাবি করলে এলাকার লোকজন আটককৃত টমটমটি ছেড়ে দেয়। তখন ঘাতকরা সকাল সাড়ে ১০টায় টমটমটি নিয়ে ভাদিকারা হতে স্বজনগ্রাম এলাকায় যায়। স্বজনগ্রাম এলাকায় পৌছার পর ঘাতকরা টমটমটি নৌকায় তুলে নদী পার করে রাসেল মিয়ার বাড়ির সামনে নিয়ে রাখে। পরবর্তীতে ২১ মার্চ পর্যন্ত টমটমটি রাসেল মিয়ার বাড়ির সামনে ছিল। এর মধ্যে রাসেল মিয়া ঘটনার বিষয়টি জসিম এর ভাই ইসলাম মিয়া’কে অবগত করে। তখন ইসলাম মিয়া আলামত গোপন করার জন্য একটি স্ট্যাম্প ও ব্যাটারীর ভূয়া কাগজ তৈরী করে ২২ মার্চ সেখানে আসে এবং টমটমটি বিক্রয়ের জন্য লোক ঠিক করতে থাকে। টমটমের ব্যাটারীতে চার্জ না থাকায় ওইদিন সকাল সাড়ে ১১টায় ঘাতকরা টমটমটি নদী পাড় করে অষ্টগ্রাম থানার ইসলামপুর এলাকার জনৈক আরজু মিয়ার গ্যারেজে নিয়ে চার্জে দেয়। গতকাল আদালতে গ্রেফতারকৃত রাসেল মিয়া ও ইসলাম মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। ঘটনায় জড়িত অপর পলাতক আসামী জসিম মিয়াকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গতকাল রাতে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম।