সে যে আমার জন্মভূমি (দশ)

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
ঝাঁসি’র রাণী লক্ষী বাঈ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাত্র বাইশ বছর বয়সেই সন্তানকে পিঠে বেঁধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং অতঃপর আহত হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। জাতীয় এই বীরাঙ্গনা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে যে ভূমিকা রেখে গেছেন তা চির অম্লান।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্যই এ কে এম ফজলুল হক শেরে-বাংলা তথা বাংলার খেতাব অর্জন করেন। গণতন্ত্রের পুরোধা এই ব্যক্তিত্ব আজো বাঙালি বা বাংলাদেশীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরঞ্জীব একজন গণতন্ত্রের মানসপুরুষ হিসেবে। জীবনে সাধারণ গরীব মানুষের জন্য অকাতরে নিজের উপার্জন বিলিয়ে দিতে সামান্যতম কার্পণ্য করেননি। দেশপ্রেমে কোনধরনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি কখনো।
নেতাজি সুবাস বসু অফুরন্ত দেশপ্রেমের কারণেই হাতে অস্ত্র তুলে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন। শোষক বৃটিশদের বিতাড়নে দেশ-বিদেশে জোর তৎপরতা চালান। এ ব্যাপারে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নায়ক জাদরেল হিটলারের সাথেও সহযোগিতার জন্য সশরীরে সাক্ষাত করেন। কতটুকু শক্ত বুকের পাটা হলে সারা বিশ্ব দাবড়ে বেড়িয়ে বৃটিশদের ত্রাস হিসেবে পরিচিতি লাভ করতঃ ‘নেতাজি’ এবং ‘দেশনায়ক’ উপাধি লাভ করতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। কথিত আছে হিটলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য নেতাজি যখন ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করছিলেন তখন বিচক্ষণ হিটলার প্রথমে উনার সাদৃশ্যের দুইজন জেনারেলকে পরপর ড্যামি হিসেবে নেতাজির সঙ্গে দেখা করতে পাঠান যাতে হিটলার মনে করে নেতাজি উনাদের সাথেই কথা বলেন। সুভাষ বসু বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। প্রথমজন আসার পর করমর্দন করে কথা বলতে চাইলে নেতাজি বললেন, ‘ইউ আর নট হিটলার’। অতঃপর দ্বিতীয়জন আসার পরও তিনি একই উত্তর দিলেন। তৃতীয়বার হিটলার এসে নেতাজির কাঁধে হাত রাখতেই উনি উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন। হিটলার জিজ্ঞেস করলেন আমিই যে হিটলার নিশ্চিত হলেন কিভাবে? নেতাজি উত্তর দিলেন, ‘সুভাষ বসুর কাঁধে হাত রেখে কথা বলে এমন সৎসাহস হিটলার ব্যতিত পৃথিবীর বুকে আর কারো নেই।’ এই ছিলেন দেশনায়ক সুভাষ বসু, এই ছিল উনার প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতা।
বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জি হাইকোর্টের বিচারক, অতঃপর ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োজিত হন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে উনারও জোরালো ভূমিকা ছিল। শেরেবাংলা একেএম ফজলুল হক উনারই ছাত্র ছিলেন এবং উনারই বাসায় একাধারে পঁয়তাল্লিশটা ফজলি আম খাওয়ার অনন্য ইতিহাস গড়েছিলেন। অগাধ ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মহান পুরুষ একদা ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে ক্যালকাটা থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন। তখনকার সময়ে সচরাচর কোন বাঙালি ট্রেনে ফার্স্টক্লাসে চড়তেন না। আশুতোষ মুখার্জি বসে আছেন, কিছুক্ষণ পর ফিরিঙ্গি এক লর্ড ঢুকলেন। ধূতি পাঞ্জাবি ও চটিজুতা পরিহিত এক ভারতীয়, তার মাঝে আবার বাঙালিকে ফার্স্ট ক্লাসে উপবিষ্ট দেখেই ইংরেজ সাহেবের মেজাজ চড়কগাছ। চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে গেল। মুখার্জিবাবু নিবিষ্ট মনে পেপার পড়ছিলেন। কামড়ায় শুধুমাত্র এ দুজনই। কোন কথাবার্তা নেই, ট্রেন চলছে। কিছুক্ষণ পর আশুতোষ মুখার্জি ঝিমুচ্ছিলেন। লর্ড সাহেব বাঙালির উপস্থিতি যেন সহ্যই করতে পারছিলেন না। রাগে, ঈর্ষায় কোন কিছু না বলতে পেরে মুখার্জিবাবুর একখানা চটিজুতো পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে বাহিরে ফেলে দিলেন। ঘুমভাব কেটে গেলে একটা জুতার অনুপস্থিতিতে মুখার্জিবাবু বুঝতে পারলেন এত ভিতর থেকে জুতা বাহিরে পড়ে যাওয়ার কথা নয়। নি:সন্দেহে এটা ঈর্ষাকাতর ফিরিঙ্গি লর্ডেরই কাজ। তিনি নিশ্চুপ বসে রইলেন। দু’এক ঘণ্টা পর খেয়াল করলেন লর্ড সাহেবও ঘুমুচ্ছেন। মুখার্জিবাবু হেঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা ইংরেজ সাহেবের মুল্যবান ওভারকোটখানা তুলে নিয়ে জানালা দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে ফেলে দিয়ে পেপার পড়তে থাকলেন। একটু পর ঘুম ভাঙ্গলে মূল্যবান জিনিস সমেত ওভারকোট না পেয়ে লর্ড সাহেব চিৎকার করতে লাগলেন, ‘হয়ার ইজ মাই ওভার কোট, হয়ার ইজ মাই ওভার কোট?’ মানে আমার ওভার কোট কোথায়? আমার ওভার কোট কোথায়?
আশুতোষ মুখার্জি গম্ভীর ভারিক্কি গলায় উত্তর দিলেন, ‘ইউর ওভার কোট হেজ গান টু ব্রিং মাই সু।’ অর্থাৎ তোমার ওভার কোট আমার জুতা আনতে গেছে।
বিচক্ষণ ইংরেজ লর্ড ঘটনা আঁচ করতে পেরে চুপ মেরে গেলেন। ইংরেজরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলে সাধারণত বেশি কথা বলেন না।
ইংরেজ বিদ্বেষী আমাদের অকুতোভয় সাহসী বাঙালি দেশপ্রেমিকগণের ভূমিকা তখন এমনতরই ছিল। ছিল নিজের জন্মভূমির প্রতি অগাধ এক ভালোবাসা। ছিল অন্যরকম এক সাহস এবং আত্মবিশ্বাস॥