হবিগঞ্জকে দাঙ্গামুক্ত শান্তিপূর্ণ জেলা হিসাবে গড়ে তুলতে চাই ॥ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শান্তিপূর্ণ ও দাঙ্গামুক্ত হবিগঞ্জ গড়ার লক্ষ্যে দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহের অভিযান শুরু করেছেন হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম পিপিএম)। তিনি শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বানিয়াচঙ্গ উপজেলার উত্তর সাঙ্গর গ্রামে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে উত্তর সাঙ্গর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে জেলা পুলিশের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় দেশীয় অস্ত্র জমাদান ও আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে গ্রামের সর্বশ্রেণীর হাজারো লোকজন অনুষ্ঠানস্থলে এসে জড়ো হন।
সভা শুরুর আগে উত্তর সাঙ্গর গ্রামের বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রধান মুরুব্বীয়ানগণের নেতৃত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পুলিশ সুপারের কাছে টেটা, ফিকল, বল্লমসহ দেশীয় অস্ত্রগুলো জমা দেয়া হয়। গ্রামবাসী প্রায় ২ হাজার অস্ত্র জমা দেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন আর দাঙ্গায় জড়াবেন না। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পুলিশ সুপার বলেন, হবিগঞ্জ একটি সুন্দর জেলা। এ জেলায় সম্ভাবনার অনেক কিছুই রয়েছে। এ জেলায় বিশে^র অত্যাধুনিক রিসোর্ট দ্যা প্যালেস রয়েছে। এখানে চা বাগানসহ পর্যটন এলাকা রয়েছে। এ জেলায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে এ জেলার একটি দুর্নাম রয়েছে। সেটি হলো দাঙ্গা। দাঙ্গা মুক্ত হলে এ জেলায় দেশের ৩/৪টি জেলার মধ্যে ১টি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি আরো বলেন, দাঙ্গা কখনও কারো জীবনে শান্তি বয়ে আনবে না। দাঙ্গা অশান্তি বয়ে আনে। তাই আপনাদের এখন সময় দাঙ্গামুক্ত হওয়ার। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম দাঙ্গা কি চিনেন না। তিনি বলেন, প্রত্যেক এলাকায় দাঙ্গা মুক্ত করার জন্য স্বেচ্ছায় অস্ত্র জমাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। যারা স্বেচ্ছায় অস্ত্র জমা দেবেন না, পরবর্তীতে পুলিশের কাছে সংবাদ যা কারো বাড়িতে অস্ত্র রয়েছে তাহলে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে জেলা জরিমানা করবেন। এতে সর্বোচ্চ ২ বছরও কারাদন্ড হতে পারে। তিনি বলেন, উত্তর সাঙ্গর এলাকার অনেকেই অস্ত্র জমা দিয়েছেন। যারা অস্ত্র এখনও জমা দেননি তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে আগামী কিছুদিনের মধ্যে অস্ত্র জমা দেন। তা না হলে আপনাদের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তিনি আরো বলেন, ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়ে সুশিক্ষিত হলে পরিবারের সুখ ও শান্তি আসবে। বাল্যবিবাহকে না বলতে হবে। ইভটিজিং, মাদক, জুয়াসহ সকল ধরণের অপকর্মকে প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের ফলে সামাজিক অবক্ষয় হচ্ছে। মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। ১৮ বছরের আগের কোন ছেলেমেয়েদের মোবাইল ব্যবহার করতে না দেয়ার জন্য তিনি অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে উত্তর সাঙ্গর গ্রামের মুরুব্বীয়ান ও যুবসমাজ ভবিষ্যতে আর সংঘর্ষে জড়াবেন না বলে অঙ্গিকার করেন। তিনি অস্ত্র জমা দেয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সকলে মিলে শান্তিতে বসবাস করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি হবিগঞ্জকে দাঙ্গামুক্ত শান্তিপূর্ণ জেলা হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বৃদ্ধি এবং লোকজনকে বিভিন্ন সামাজিক কাজে জড়িত রাখার আহবান জানান তিনি।
বানিয়াচং থানার ওসি রঞ্জন সামন্তের সভাপতিত্বে এবং উপ-পরিদর্শক ধ্রুবেশ চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) এস এম ফজলুল হক, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মো. সেলিম। বক্তৃতা করেন মন্দরী ইউপি চেয়ারম্যান শেখ সামছুল হক, জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মহিবুর রহমান মাহি, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন খান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ইদ্রিছ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জাহির। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এলাকার বিশিষ্ট মুরুব্বী এমএ রব, নূরুল হুদা, আব্দুল হেকিম ফুল মিয়া, ফারুক হোসাইন বেলু, আব্দুল আউয়াল মেম্বার, জাহাঙ্গীর আলম আনছারী, আলাউদ্দিন মেম্বার, ছাত্রলীগ নেতা এমজি কাদিরসহ এলাকার মুরুব্বীয়ান। সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৪ অক্টোবর সালিশের রায়ে নির্ধারিত জরিমানার টাকা না দেয়ায় দু’পক্ষের সংঘর্ষে শতাধিক লোক আহত হয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে ৪০ জনকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি এবং টেটাবিদ্ধ (বল্লম) অবস্থায় ২০ জনকে সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সংঘর্ষে জড়িত ২২ জনকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ সেখান থেকে একটি রিভলবার ও ৩ রাউন্ড গুলিও জব্দ করে।
এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর হাওর এলাকার এই গ্রামে কিভাবে মানুষকে দাঙ্গা থেকে বের করে নিয়ে আসা যায় তার জন্য কৌশল বের করেন হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা। তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং সার্কেল) শেখ সেলিম ও বানিয়াচং থানার ওসি রঞ্জন সামান্তকে পাঠিয়ে উত্তর সাঙ্গর এলাকার জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করান। এ প্রেক্ষিতে সকলেই দাঙ্গা নয়, শান্তি চায় বলে জানায়। এ প্রেক্ষিতে শনিবার বিকেলে উত্তর সাঙ্গর গ্রামে জেলা পুলিশ প্রশাসন দাঙ্গা, মাদক, জঙ্গী সন্ত্রাস রোধকল্পে দেশীয় অস্ত্র জমাদান ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্যা দেশীয় অস্ত্র জমাদানের আহবান জানালে গ্রামের সকল গোষ্ঠীর লোকজন দল বেধে ফিকল, টেটা ও বল্লমসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রগুলো জমা দেন।
উত্তর সাঙ্গর গ্রামের যুবক আব্দুর রহমান বলেন, আমরা সকলে মিলে অস্ত্র জমা দিয়েছি। আর কোনদিন আমরা কোন ধরনের সংঘর্ষে জড়াব না। এর আগে যেসব সংঘর্ষ হয়েছে তাতে এলাকার বহু লোক পঙ্গু হয়েছে। মামলার কারণে অনেকেই সর্বশান্ত হয়েছেন। নিজেরা নিজেরা ঝগড়া না করলে আজ এই পরিণতি হত না। তিনি পুলিশের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন।