মমতাভরা শিহরণ জাগানো দেশাত্মবোধক গানগুলো যখন দেশপ্রেমের এক অনুপম সুরে বাজতে থাকত তখন সমস্ত শরীরে একটা অদৃশ্য স্পন্দন তৈরি হত

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

যখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি অর্থাৎ যখন ১৯৬৬, ১৯৬৭ সাল তখন গ্রামাঞ্চলে রেডিওর সংখ্যা খুব একটা ছিলনা। দু’চারটা বাড়িতে কলের গান বা গ্রামোফোন ছিল। ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’ থেকে মাঝে মাঝে দেশাত্মবোধক গান দিলে তন্ময় হয়ে গানগুলো শুনতাম। মনের অজান্তে কোমল হৃদয়ে দেশের প্রতি একটা ভাল লাগা সৃষ্টি হতে শুরু করল। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময়ে স্বাধীকার চেতনা ও একুশে ফেব্রুয়ারির অনুভূতি কিশোর মনে অন্যরকম এক স্পন্দন তৈরি করতে লাগল।
ঐ মুহূর্তে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটা হৃদয়ে দারুণ রেখাপাত করেছিল। তাছাড়াও ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’, ‘ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা, আমারই এ দেশ বসুন্ধরা’ গানগুলোও দেশের প্রতি মমত্ববোধ বাড়াতে লাগলো ক্রমশ।
১৯৭১, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হল। ত্রিশ চল্লিশ কিলোমিটার দূর প্রিয় বিদ্যাঙ্গন ছেড়ে বাড়ি চলে আসলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরম পত্র’, সংবাদ বুলেটিন, দেশাত্মবোধক বৈপ্লবিক গানসমূহ এবং ‘আকাশ বাণী’ কলকাতার বাংলা সংবাদ শোনার জন্য তখন ঘরে ঘরে রেডিও। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে রেডিও শোনার প্রতি নিয়ন্ত্রণ বা বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এ কালো আইনের কোন প্রভাব ছিল না, ছিল না জনমনে তেমন কোন ভয়ভীতি। তাই ক্ষেতে খামারে কাজ করার সময় বা বাড়ির পাশে খলায় দলবেঁধে সোনালী ফসল তোলার ক্ষণে সকল পরিবারেই নিদেন পক্ষে এক ব্যান্ডের একটা রেডিও থাকত যা থেকে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ শোনা যেত রাত দশটায়। শিক্ষিত জনেরা বিবিসি শোনার জন্য তিন ব্যান্ডের রেডিও রাখতেন যদিও তা ছিল হাতে গোনা।
কিশোর বয়স আর বয়ঃসন্ধিক্ষণের ত্বড়িৎ মানসিক পরিবর্তন তৎসঙ্গে এ সময়টাতে মাত্রাতিরিক্ত আবেগের উপস্থিতি দেশপ্রেম ও পারিপার্শ্বিক থমথমে ভাবটাকে দারুণভাবে উপলব্ধি করার একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল। তাই রেডিওতে যখন তখনকার গীতিকারদের অন্যরকম দরদ দিয়ে লেখা দেশাত্মবোধক গানগুলো দেশপ্রেমের এক অনুপম সুরে বাজতে থাকত তখন সমস্ত শরীরে একটা অদৃশ্য স্পন্দন তৈরি হত। আমার চেয়ে সাত, আট বছরের বড় যৌবনোদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে এসব গানের প্রভাব নিশ্চয়ই অন্যরকম এক উদ্দীপনা সৃষ্টি করত বলেই স্বাধীনতা যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল অনেক সংকুচিত হয়ে এসেছিল বলে আমি মনে করি।
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল’ গানে সকলের মনে অভাবনীয় জোয়ার জাগায়নি কেবল, সাহসও যুগিয়েছিল সীমাহীন। ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী তল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল, চলরে চলরে চল্’ নজরুলের কালজয়ী এ সামরিক গান সমরযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উদ্দীপ্ত করেছিল সন্দেহাতীতভাবেই। আমাদের বয়সের কিশোরদের তখনো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরিপক্কতা বা সময় হয়নি। তবু এ সকল গানের আবহ সুপ্ত মনে যে অদৃশ্য দামামা বাজিয়ে তুলত তা দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য কোন অংশেই কম ছিল না অগ্রজদের তুলনায়।
এমনি করে ‘নোঙ্গর তোল তোল, সময় যে হোল হোল’ বিবেককে কম নাড়া দেয়নি।
রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া..
‘ছোটদের বড়দের সকলের, গরিবের নিঃষের ফকিরের; আমারি দেশ সব মানুষের সব মানুষের সব মানুষের…’
এ ছোট্ট ভূখন্ডের সকল মানুষকে হৃদয়, মন, মনন ও মস্তিষ্ককে একাকার করতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
গীতিকার আবদুল লতিফের অমর সৃষ্টি ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি, বলো যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটিরে আমার জন্মভূমির মাটি’ কালজয়ী এ গান বাঙালির দেশপ্রেমকে বাড়িয়ে দিয়েছিল বহুমাত্রিকভাবে।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে এসকল গান বাজতে থাকলেও কখনো কারো মনে বিরক্তির ছোঁয়া লাগেনি একটুখানি।
ভাললাগাতো ভাললাগাই, ভালবাসাতো ভালবাসাই। ভাললাগা এবং ভালবাসার মানুষটা সম্পর্কে কোন কথা বা প্রশংসা যেমন কখনো কারো হৃদয়ে কোন বিরক্তি তৈরি করার অবকাশ রাখে না, তেমনি আমার দেশ, আমার জন্মভূমি, যে ভূমিতে আমার নাড়ি প্রোথিত আছে জন্মলগ্ন থেকে, যে ভূমিতে হামাগুড়ি দিয়ে আমি একদিন হাঁটতে শিখেছি, যে দেশের খোলা মাঠে দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছি, লম্বাদৌঁড়, গোল্লাছুট খেলেছি, যে ভূখন্ডের খাল, বিল, পুকুর, নদী নালায় ঝাঁপাঝাপি করেছি, সে দেশটা নিয়ে মমতাভরা, শিহরণ জাগানো এসকল দেশাত্মবোধক গান কভু বিরক্তি তৈরি করবে প্রশ্নই উঠে না। বরং অন্যরকম এক মমত্ববোধ বা দেশপ্রেম হৃদয়ে নতুনভাবে দানা বাঁধে যা আজীবন লালিত হয় নিখাঁদ এবং নির্ভেজালভাবে। যে অনুভূতিতে কখনো মরিচা ধরে না, যে অনুভূতির কোন ক্ষয় নেই, নেই অবক্ষয় ভাললাগার গুণগত মানের।
চিৎকার করে বলতে দ্বিধা থাকে না,
‘হে আমার জন্মভূমি, আমি তোমায় ভালবাসি।’