আমার সন্তানেরা আজ এসিতে বসে অফিস করে, এসি রুমে বসে পড়াশোনা করে, এসি গাড়ি চড়ে কলেজে যাতায়াত করে। আজিকার এমতাবস্থায় পৌঁছুতে আমার এ বন্ধুর, কষ্টকর, বিপদসংকুল পথ পরিক্রমা কি ওরা কখনো যথাযথ আন্দাজ করতে পারবে? জীবন সংগ্রাম যে কত কঠিন তা কি কভু তাদের অনুভূতিকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করবে

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

প্রৌঢ় বয়সে ডাক্তারদের প্র্যাক্টিস মোটামুটি জমজমাটই থাকে। চেম্বারে রোগীর কোলাহল আর দিনশেষে পকেট ভর্তি খুচরা টাকা গুনার মাঝে কিছুটা আনন্দ আছে। হররোজ বান্ডিল হিসেবে রুজি করতে হলে বড় ব্যবসা ধরতে হবে অথবা প্রতিদিন বেতন পাওয়ার মত অর্থাৎ বেহিসাবি বকশিশ, কমিশন বা পার্সেন্টেজের সিস্টেম ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিদিন এ একত্রিভূত খুচরা টাকার সন্তুষ্টিতেই আনন্দে আত্মহারা না হওয়ার কোন কারণ নেই। তৎসঙ্গে মুমূর্ষু এবং জটিল রোগীদের সুস্থ হওয়ার পর কৃতজ্ঞতা ভরা অভিব্যক্তিটাও কম আনন্দের কিসের। দ্বিতীয়টার আত্মতৃপ্তি অবশ্যই ভিন্নরকম। তাই মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেলেও এ ঘুরপাকে পড়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন বা স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি করা হয়ে উঠেনি তখনো।
একদিন রোগী দেখা শেষ করে চেম্বার থেকে প্রায় চৌদ্দ পনর কিলোমিটার দূরে চা বাগান পেরিয়ে রঘুনন্দন পাহাড়ি এলাকায় কলে যেতে বাধ্য হলাম বিশিষ্ট জনদের অনুরোধেই। বাহন নিজস্ব ইঞ্জিনচালিত দ্বিচক্রযান বা মোটর সাইকেল। সাথে পেছনের সিটে রোগীর নিজস্ব লোক। ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস ম্যালেরিয়া এবং চিকিৎসা প্রদানের পর অনুরোধের আসরের রোগী, খোশগল্প, আন্তরিক আপ্যায়ন, এমন করে গোধূলি আসন্ন প্রায়। পাহাড়ি অঞ্চল ঘেষে অতঃপর চা বাগানের ভিতর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার আসার পর পাকা রাস্তা ধরে জেলা সদরে বাসায় পৌছুতে প্রায় আরো পঁচিশ কিলোমিটার পথ। রোগীর লোকজন এগিয়ে দিতে চাইলেও চেনাপথ, তারুণ্যসুলভ মনোভাব, আত্মবিশ্বাস সব মিলিয়ে একাই রওয়ানা দিলাম।
আষাঢ়ে আকাশে মেঘের ঘনঘটা, মাঝে মাঝে বিজলী সহ কানফাটা শব্দ কানের কম্পমান পর্দা ভেদ করে কানের অভ্যন্তরীণ তরল পদার্থে যে জলতরঙ্গ সৃষ্টি করে তাতে কানে আঙ্গুল দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। লালমেটে পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ যখন প্রায় শেষ তখনি মুষলধারে অঝোরে বৃষ্টি। একটা বড় কাঁঠাল গাছের নিচে হেলমেট মাথে দাঁড়িয়ে রইলাম বোকার মতই। আধঘণ্টা পর একেবারে না থামলেও কিছুটা কমে আসল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার যা শরৎ চন্দ্রের আঁধারকেও হার মানায়। ফিরে রোগীর বাড়ি যাব না বাসার দিকে পাড়ি দেব দোটানায় পড়ে গেলাম। তখন মোবাইল ছিল না, বাসায় না ফিরলে যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তা আগামী বারো ঘণ্টায় নিরসনের কোন উপায় নেই।
হেড লাইট জ্বেলে বাগানের কাঁচা রাস্তা ধরেই আবার যাত্রা শুরু। জনমানবহীন ভুতুরে এক পরিবেশ। চারিদিকে জোনাকি পোকার আলো কিছুটা সাহস সঞ্চয় করলেও ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ বিপরীত ভূমিকাই রাখল। গাড়ির গতিবেগ দ্বিতীয় গিয়ারে রেখে এগুতে থাকলাম। পেট্রোল খুব একটা বেশি যে আছে তাও নয়। পনের বিশ মিনিট পর এক চৌরাস্তায় পৌঁছলাম।
ঘনান্ধকারে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম এরিমধ্যে তালগোল পেকে গেল। থামতে বাধ্য হলাম। বরাবর প্রায় কিলো খানেক যাওয়ার পর আবার ফিরে এলাম, এভাবে তিন রাস্তাধরে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটল। ভাগ্য ভাল বৃষ্টির বদৌলতেই হয়ত বানর বা নিশাচর শেয়াল চোখে পড়েনি। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। মোটরসাইকেল ছাড়া পদব্রজে সাধারণত কেহ এপথ মাড়ায়না। উপায়ান্তর না পেয়ে চৌরাস্তাতেই হেড লাইট জ্বালিয়ে রেখে নেমে দাঁড়িয়ে রইলাম। সিগারটের অভ্যেস নেই, সুতরাং সময় কাটানো বা ত্বড়িৎ চিন্তার জট খুলে যাওয়ারও কোন সম্ভাবনা দেখছি না। গাড়ির পেট্রোল তখনো রিজার্ভে পৌঁছায়নি যা মনে কিছুটা সাহস যোগাল।
ভাবলাম প্রতিটি রাস্তাধরে তিন কিলো করে আবার আগের মতো রিহার্সাল দিব। হয়ত একটা সুরাহা মিলে যেতেও পাড়ে। দাঁড়িয়ে দাদীর বলা অনেক গল্প মনে পড়তে লাগল। এক সময়ে এ পাহাড়ে নাকি অনেক বাঘ ছিল। এই বর্ষায় ছন কাটার মৌসুমে কাটুরিয়াগণ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সবার নিকট থকে বিদায় নিয়ে আসতেন হয়ত কাউকে না কাউকে বাঘের কবল থেকে আর নিজ পরিবারে ফেরত না ও আসা হতে পারে, যা অনেকটা সুন্দর বনের মৌয়ালি বা মধুকরদের মতই। আগুন জ্বালিয়ে রাখলে বাঘ নাকি কাছে আসেনা। দাদী এও বলতেন বাঘ চারিচোক্ষে কাউকে খায় না। পেছন থেকে সাধারণত হামলা করে। যদি হামলা করেও ফেলে বাঘের মুখের ভিতরে সুযোগ করে একটা হাত ঢুকিয়ে দিতে পারলে বাঘ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। অবশ্য পরে বই পড়ে জেনেছি বাঘের মুখের হলকমের ভিতরে হাত ঢুকাতে পারলে যে বমিভাব সম রিফ্লেক্স তৈরি হয় তার কারণে বাঘ ছেড়ে দেয়। দাদী এও বলতেন সাহস করে সামনে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করলেও অনেক সময় বাঘ হটে যায়। প্রয়াত দাদীর কথা বারবার মনে পড়তে লাগল।
এছাড়াও রাতে অত্র এলাকায় শুনেছি ডাকাতরূপী মানুষ নামক বাঘেদের বিচরণ আছে। তবে হঠাৎ ঝড়ো বৃষ্টির পর এ সম্ভাবনা হয়তবা ক্ষীণ।
রাত তখন ন’টার কাছাকাছি। বলা চলে আমি প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বৃষ্টিতে যতটুকু না ভিজেছি তার চেয়েও অভ্যন্তরীণ স্টেরয়েড হরমোন নিঃসরণের কারণে শরীর ঘামছে প্রচুর। অথচ কথা ছিল শীতে কাঁপুনি ধরার।
ভাবছি, যদি আবারো বড় ঝড় শুরু হয়, কি করা উচিৎ। হোন্ডা এখানে রেখে অনতিদূরে চা বাগানের ছায়া গাছ বা শেড ট্রি এর নীচে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। অতি বর্ষণে আমারই মত প্রৌঢ় দ্বিচক্রযানখানা বিশ্বাসঘাতকতা করলে বা নষ্ট হয়ে গেলে কিছুই করার নেই। সাথে আত্মরক্ষামূলক কোন ছোটখাট হাতিয়ারও নেই। মনে হত এ বয়সে শিক্ষিত ভদ্রলোকের এসব সঙ্গে রাখা যেন অভদ্রতার নামান্তর। অগত্যা কোমড়ের বেল্টটা খুলে হাতে নিয়ে রাখলাম।
আমি যেভাবে এখানে দাঁড়িয়ে টেনশন ভোগ করছি হয়তবা গিন্নিও বাসার বারান্দায় কত সমূহ বিপদ ভেবে পায়চারি করছে। চার পাঁচ বছরের ছেলেটাও আমি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত ঘুমায় না। বাড়িতে থাকা জন্মদাতা মায়ের মনটাও আনচান না করে থাকার কথা নয়।
এভাবে হয়ত দাঁড়িয়ে নির্ঘুম সারারাত কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। যদি বৃষ্টি বেড়ে যায়, পেট্রোল শেষ হয়ে হেড লাইট নিভে যায় বিপদ বাড়তে পারে। একসময়ে ভিজা কাপড় আর ভিজা শরীরে ঠান্ডাতো লাগবেই। এমনতর অনেক কল্পনা ভিড় করতে লাগল। ঘড়িতে চেয়ে দেখি রাত পৌনে দশটা। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিয়াল মামার হুক্কাহুয়া চেনা চিৎকার কানে আসতে লাগল। শান্ত মস্তিস্কে দিগি¦দিক অবস্থায় পড়ে নতুন কোন সিদ্ধান্তের পথ খুজতে শুরু করলাম। একজন মুসলিম হিসেবে আমি একা নই, আমার সৃষ্টিকর্তা সাথে আছেন এ ধারণা তখন আরো বদ্ধমূল হতে থাকল।
হঠাৎ পেছনদিক থেকে একটা কাশির আওয়াজ পেলাম। ইচ্ছে করেই গাড়িতে চড়ে ঘুরে হর্ণ চাপলাম দুবার। দেখি ক্ষীণকায় নিকষ কালো এক আশরাফুল মাকলুকাত মাথায় গামছা বাঁধা, পরনেও গামছা, হাতে চিকন লম্বা দা সমেত একেবারে আমার কাছাকাছি। আমি নড়াচড়া না করে অবস্থা কিছুটা পর্যবেক্ষণ করছি কেবল। পাশে এসেই বলে উঠলো সালাম ডাক্তার বাবু, এত রাতে আপনি এখানে? পথ হারিয়ে ফেলেছেন বুঝি?
আন্দাজ করলাম আমারই কোন রোগী এবং এ বাগানের তামিল বংশীয় আদিম সম্প্রদায়েরই একজন যাদের একজানালা বিশিষ্ট ছোট মাটির ঘরে বসবাস এবং স্বল্প মজুরীতে এ বাগানেই চাকুরী। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মনে হল পিপাসার্ত পথিকের সামনে এক বাটি ঠান্ডা শরবতের উপস্থিতি যেন। বামদিকের এক রাস্তা দেখিয়ে দেয়া মানুষরূপী এ ফেরেস্তার সহায়তায় যে স্বস্থি ফিরে পেয়েছিলাম তা স্বল্প জীবন পরিক্রমায় বিরল ঘটনাতো অবশ্যই।
বিজলীহীন শহরে বাসার নিচে যখন পৌঁছলাম রাত এগারটা। মনে হল সহধর্মিনী বারান্দায় ঠিকই পায়চারি করছে। ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকার মুহূর্তে আমার শুকনো হাসি দেখে গিন্নি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছে আজ কোন বিপদ কাটিয়ে এসেছি।
আমার সন্তানেরা আজ এসিতে বসে অফিস করে, এসি রুমে বসে পড়াশোনা করে, এসি গাড়ি চড়ে কলেজে যাতায়াত করে। আজিকার এমতাবস্থায় পৌঁছুতে আমার এ বন্ধুর, কষ্টকর, বিপদসংকুল পথ পরিক্রমা কি ওরা কখনো যথাযথ আন্দাজ করতে পারবে? জীবন সংগ্রাম যে কত কঠিন তা কি কভু তাদের অনুভূতিকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করবে?
হয়ত কাহিনীটা অন্যরকম হতে পারতো, পরদিন কোন খবরের কাগজে হৃদয়স্পর্শী শিরোনাম হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারতো যেমন করে অনেক নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয়ে আমরা বেঁচে আছি।
তাই অন্যরকম বিষাদময় এ অনুভূতিটুকু আজো একটু একটু পীড়া দেয় বৈ কি।