এসএম সুরুজ আলী ॥ আজ ১৮ সেপ্টেম্বর লাখাই’র কৃষ্ণপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে লাখাই উপজেলার হিন্দু এলাকা হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণপুর গ্রামের ১২৭ জন নিরীহ ব্যক্তিকে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী। ওই দিন গ্রামের অনেক নারী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে সম্ভ্রম হারান। হত্যাযজ্ঞের ৪৭ বছর পরও শহীদদের তালিকায় নাম উঠেনি নিহতদের। আহত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নেই গুলি খেয়েও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের। তবে কৃষ্ণপুর গ্রামে গণহত্যার নায়ক পাকিস্তানীদের দালাল রাজাকার লিয়াকত আলীসহ তার সহযোগিদের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। লাখাই উপজেলার ১নং লাখাই ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামটিতে প্রায় ২ হাজার লোকের বসবাস। গ্রামের সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা শিক্ষা বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী (অব:) প্রদীপ কান্তি রায় জানান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কৃষ্ণপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা অমরেন্দ্র লাল রায়ের নেতৃত্বে অনেক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতে চলে যান এবং সরাসরি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। অপরদিকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসাবে নিরাপদ মনে করে গ্রামের মানুষের আত্মীয়-স্বজনসহ বহু মানুষ পালিয়ে এসে গ্রামটিতে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৫ টার দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং এলাকার স্থানীয় রাজাকার আলবদর বাহিনী পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলে। তখন ছিল বর্ষাকাল, গ্রামের চতুর্দিকে ভরাবর্ষার পানি। গ্রামের মানুষ টের পেয়ে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করতে থাকে। অনেকে ভয়ে পুকুরের কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে থাকে। অন্যদিকে গ্রামে চলতে থাকে হানাদার বাহিনীর নিষ্টুর নির্যাতন। যাকে যেভাবে পেয়েছে গুলি করে কিংবা বেয়নেট দিয়ে খুচিঁয়ে হত্যা করতে থাকে। অনেককে ধরে এনে যদু নন্দন রায়ের দেয়াল ঘেরা বাড়িতে লাইনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে। যুবতী মেয়েদের ধরে এনে সম্ভ্রম হানি ঘটায়। ওই দিন বিকাল ৫ টা পর্যন্ত তারা এই পৈশাচিক কান্ড চালিয়ে যায়। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী গ্রামের ও গ্রামের বাইরের মোট ১২৭ জনকে নিষ্টুুরভাবে হত্যা করে। অনেকে মারাত্মক আহত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন ধর্মীয় মতে এই লাশগুলোর সৎকার করা সম্ভব হয়নি। লাশগুলো বর্ষার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। যারা বেঁেচে গিয়েছিলেন তারা পরবর্তীতে আবারো আক্রমণের ভয়ে ওই দিন রাতে যে যেভাবে পারেন পালিয়ে গিয়েছিলেন। ওইদিন কোন বাড়ি তাদের হত্যাকান্ড ও লুটতরাজ থেকে রক্ষা পায়নি। তিনি আরো বলেন- স্বাধীনতার ৪৭ বছর আমরা অতিক্রান্ত করেছি। বারবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এসব শহীদের স্মরণে সরকারিভাবে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। ২০০৯ সালে অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির নির্বাচিত হওয়ার পর ২ কিস্তিতে ৩ লাখ টাকা সরকারি বরাদ্দ দেন এবং ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করার মাধ্যমে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শিক্ষা বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী (অব:) প্রদীপ কান্তি রায় বধ্যভূমি নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করেন। বরাদ্দকৃত টাকা দ্বারা মাটি ভরাটসহ অনুসাঙ্গিক কিছু কাজ করলেও কাজটি অর্ধসমাপ্ত ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে ৩০ লাখ শহীদ আত্মদান করেছেন তাদের সাথে আছে কৃষ্ণপুর গ্রামের ১২৭ জন শহীদের আত্মদান। একদিন হয়ত ভবিষৎ প্রজন্ম শহীদদের সুমহান আত্মদানের কথা ভুলে যাবে। কৃষ্ণপুর গ্রামের অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে গ্রামের ১২৭ জন শহীদের বীরত্বগাথা জানতে পারে এজন্য গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অমরেন্দ্র লাল রায়ের উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং গ্রামবাসী সকলের সহযোগিতায় এখানে বধ্যভূমি নির্মিত হয়েছে। প্রতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মরণে আনুষ্ঠানিকভাবে পুষ্পস্তবক অর্পন, সাংস্কৃতিক অনৃষ্ঠান ও আলোচনা সভার মাধ্যমে মর্যাদা সহকারে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষনরত অবস্থার প্রতিকৃতি, ৩ জন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি ও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভসহ জাতীয় দিবসগুলো উদযাপন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করার কাজ চলমান রয়েছে। মূল পরিকল্পনায় একটি গেস্টরুম, আলোকশয্যা, ফুলের বাগানসহ আনুসাঙ্গিক কিছু সৌন্দর্য্য বর্ধক কাজ অন্তর্ভূক্ত থাকিলেও বরাদ্দের অভাবে এখনই বাস্তবায়ণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পরবর্তীতে সরকারি-বেসরকারি বরাদ্দ পাওয়া গেলে বাকী কাজ সম্পন্ন করা হবে।
১৯৭১ সালের এই দিনে ১২৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com