বিভাগীয় কমিশনার বললেন ‘চাকরিতে পারিবারিক ইমোশনের কোনো স্থান নাই’
চাকরি তবে করি কেন যদি পরিবারের কোনো কাজেই না লাগি
আতাউর রহমান কানন
২৬ জুলাই ২০০৭, বৃহস্পতিবার। বেশ কয়েকদিন বৃষ্টিবিহীন দিন থাকার পর আজ সকাল থেকেই আবার শ্রাবণের বারিবর্ষণ শুরু হয়। এমন বরষার দিনে বাসাই যেন আনন্দধাম। কিন্তু আমার তো সে সুযোগ নেই। আজ অফিসে পূর্বনির্ধারিত ৪টি সভা রয়েছে। আমার বাবুর্চি সকালের নাশতায় দিয়েছে খিচুড়ি। সে সঙ্গে ডিমভাজা, হাঁসের মাংস আর সরিষার তেলে পেঁয়াজ-পোড়া মরিচের ভর্তা। আমি ডিমভাজা আর পেঁয়াজ-মরিচের ভর্তা দিয়ে একরকম পেটপুরে খাই। হাঁসের মাংস পড়েই রইল।
নাশতা সেরে ঝুমবৃষ্টির মধ্যেই সকাল ৯টায় অফিসে যাই। নির্ধারিত সভাসমূহ ও অফিসের কাজকর্ম সেরে বিকেল সাড়ে ৫টায় বাসায় ফিরে আসি। রাত ৮টায় ঢাকা থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীবন্ধু আতিয়ার ও ইমতিয়াজ সপরিবারে বিনা সংবাদে আমার বাসভবনে এসে উপস্থিত হয়। আমি তাদের দেখে অপ্রস্তুত হলেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এটা আমাদের ঘনিষ্টতার সারপ্রাইজ বটে! তাদের জন্য রান্না-বান্নার আয়োজন চলল একদিকে। অন্যদিকে আমাদের হৈহুল্লোর গল্পগুজব। সময় খুবই দ্রুত চলে যেতে থাকে। রাত গভীর হয়। খাওয়া-দাওয়া শেষে তাদের আমার বাসার কাছেই জেলা পরিষদের ডাকবাংলোতে ঘুমাতে পাঠাই। জেলা নাজির তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকেন।
পরের দিন শুক্রবার আকাশটা অস্বাভাবিক ভালো হয়ে যায়। আমার করিৎকর্মা জেলা নাজির আবদুস সামাদ সকালে হবিগঞ্জ বাজারে পছন্দসই মাছ না পেয়ে ভৈরব গিয়ে একটি মানসম্মত রুই ও একটি কাতলা মাছ নিয়ে আসেন। আর স্থানীয় বাজার থেকে একটি খাসির ব্যবস্থা করেন। দুপুরে বন্ধু ও বন্ধুপতœীদের সে সব দিয়ে আপ্যায়ন করি। তারা একটি চা বাগানে বেড়ানো ও রাতে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করায় সে ব্যবস্থাও করা হয়। তাদের বিকেল ৫টায় মাধবপুরের সুরমা চা বাগানে পাঠানো হয়। আমার পাঠানো মেহমানদের সম্মানে বাগান ম্যানেজারের দেওয়া ডিনারে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করি। আমার মেহমানগণ সকালে বাগান থেকেই ঢাকা চলে যাবে। তাদের কাছ থেকে আমি বিদায় নিয়ে রাত ১১টায় নিজ বাসায় ফিরে আসি। পুরানো বন্ধুদের নিয়ে দিনটি আমার বেশ আনন্দেই কেটে যায়। এ আনন্দের সাথে আর কিছুর তুলনা চলে না।
২৯ জুলাই ২০০৭, রবিবার। আজ বাইরে কোনো ট্যুর না থাকায় অফিসেই থাকি। বিকেল ৪টায় সমাপ্তকৃত কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য মেলার প্রবেশ টিকিটের ড্র বিজয়ীদের মধ্যে চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ভবনে গিয়ে পুরস্কার বিতরণ করি। চেম্বার প্রেসিডেন্ট মো. তকাম্মুল হোসেন কামাল এতে সভাপতিত্ব করেন। প্রথম পুরস্কার মটরসাইকেল পান লাখাই উপজেলার জুনায়েদুল ইসলাম।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জেলা ক্রীড়া সংস্থায় যাই। সেখানে আজ বিশেষ সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়েছে। ঝিমিয়েপড়া ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণের সঞ্চার ফিরিয়ে আনার জন্য নানামুখী উদ্বোগ নেওয়া হয়েছে। আজ পুরাতন কমিটিকে কণ্ঠভোটে পুনর্গঠন করে নতুনরূপ দেওয়া হয়। কমিটি গঠনের আগে বিগত দুবছরের কর্মকান্ড ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সফিকুল বারী আউয়াল পেশ করলে তা আলোচনা-পর্যালোচনা করে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরের দিন সাড়ে ১১টায় সেনাবাহিনীর উপঅধিনায়ক মেজর আরিফ মোহাম্মদসহ স্পিডবোটে বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করি। জলসুখা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, কেজিপি হাইস্কুল ও নোয়াঘর প্রাইমারি স্কুলে আশ্রিতদের সরেজমিন দেখি এবং আমার সঙ্গে নেওয়া চাল ও অন্যান্য জরুরি পণ্য বিতরণ করি। দেড়টার সময় আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় গিয়ে উপজেলা সদরের চরবাজার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করি। বন্যার পানি আজ থেকে কমতে শুরু করেছে জেনে এলাকাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি লক্ষ্য করলাম। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জরুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, চিকিৎসা ও জরুরি ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য নির্দেশনা দিই। বিকেল ৪টায় হবিগঞ্জ সদরে ফিরে আসি।
৩১ জুলাই ২০০৭, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। রাজনৈতিক বন্দি (ডিটেইনি) বিষয়ক জেলা রিভিউ কমিটির সভা করি। এরপর নানাবিধ কাজকর্মে প্রায় সারাদিন কেটে যায়। বিকেল ৪টায় দি রোজেস কালেক্টরেট স্কুলে গিয়ে ম্যানেজিং কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করি। সভা শেষে বাসায় এসে জরুরি ডাক ফাইল খুলে দেখি বিভাগীয় কমিশনারের অফিসের একটি ফ্যাক্স বার্তা। বার্তাটি আমার একদিনের ছুটি নামঞ্জুরের। আমি আমার ভাতিজি পূর্নিয়ার বিয়ে উপলক্ষ্যে ২রা আগস্ট একদিনের ছুটি চেয়ে আবেদন করেছিলাম, মাননীয় কমিশনার আজিজ হাসান বিনা বাক্যব্যয়ে তা নামঞ্জুর করেছেন। আমি গত মার্চ মাসের পর কোনো ছুটিতে যাইনি। বাড়ির বিবাহ অনুষ্ঠানে আমি সপরিবারে উপস্থিত থাকি- এটা সবাই কামনা করে। এছাড়া আমিই এ বিয়ের জন্য আমাদেরই ক্যাডারের পাত্র ঠিক করেছি।
ছুটি নামঞ্জুরে আমি একরকম বেকায়দাতেই পড়েছি। আমি কিছুটা সময় নিয়ে রাতে কমিশনার সাহেবকে ফোন করলাম। তিনি আমার কোনো যুক্তিই শুনতে নারাজ। উপরন্তু ‘চাকরিতে পারিবারিক ইমোশনের কোনো স্থান নাই’ বলে টেলিফোন রেখে দিলেন। আমাকে আর কথা বলার সুযোগ দিলেন না। ছুটি নিয়ে এমন আচরণ আমার চাকরিজীবনে প্রথম বলে বেশ খারাপ লাগল। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে ভাবলাম, চাকরি ক্ষেত্রের সরাসরি অভিভাবক বললেন কী! চাকরি তবে করি কেন? যদি পরিবারের কোনো কাজেই না লাগি, তবে এমন গোলামি করব কেন? জনস্বার্থের চাকরি কি পরিবার বিবর্জিত? আমি আরও কিছুক্ষণ নিজের মনে ফোঁসফোঁস করে একরকম দমে রইলাম, কিন্তু হাল ছাড়লাম না। ৩ তারিখ শুক্রবার বিয়ে। মাঝে দুদিন সময় আছে, দেখা যাক কী হয়। না হয় ছুটি ছাড়াই শুক্রবার সকালে গিয়ে রাতে ফিরে আসব। রাতটা বেশ অস্বস্তিতে কাটালাম।
পরের দিন সকাল থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। আমি নাশতা খেয়ে যথাসময়ে অফিসে যাই। বাইরে কোনো কাজ না থাকাতে সারাদিন অফিসেই ছিলাম। বৃষ্টির কারণে অফিসে তেমন একটা ভিড়বাট্টা ছিল না। দু-একজন ভিজিটর সাক্ষাতে এসেছিলেন। তাদের সমস্যা শুনেছি। অফিস শেষে সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসি।
২ আগস্ট ২০০৭, বৃহস্পতিবার। আমার ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু নামঞ্জুর হওয়ায় আমি সারাদিন অফিস করি। বাড়ি থেকে বড় ভাই ফোন করেছিলেন- আমি রওনা হয়েছি কিনা জানতে। আমি তাঁকে জরুরি কাজের ব্যস্ততার কথা বলে একটা বোঝ দিই। ডিসি দেশের একজন মহাব্যস্ত অফিসার বটে! একদিন ছুটিতে গেলে জেলা ডুবে যাবে যে! কেন যেন এসময় হঠাৎ করে কমিশনারের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে তাঁর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে চেয়েও পারলাম না। সুমন কুমনটাকে বাঁধা দিয়ে বলল, এমন হতে নেই! বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
আমি ছুটিতে না যাওয়ায় বিকেলে আমার ব্যাচমেট হবিগঞ্জের এডিসি (রেভিনিউ) আমিনুল ইসলামের বদলিজনিত ফেয়ারওয়েলের আয়োজন করা হয়। আমি সে অনুষ্ঠানে যোগদান করি।
রাতে একবার ভাবছিলাম, কমিশনার সাহেবেকে ফোনে অনুরোধ জানিয়ে বলি- ‘ছুটি নামঞ্জুর হওয়ায় তো ঢাকায় যাইনি। শুক্রবার বন্ধের দিনটা একটু কনসিডার করেন। সকালে গিয়ে রাতেই ফিরে আসব।’ কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর বিগত দিনের কাঠখোট্টা বাক্যবান মনে পড়ায় থেমে গেলাম। ভাবলাম, আজ না কাল সকালে বলব। তিনি অনুমতি না দিলে সরাসরি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মহোদয়কে অনুরোধ জানাব। আমি তাঁর সাথে একসময় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। তিনি আমাকে ভালো করেই চিনেন। আশা করি বিফল হব না। যদিও ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া হবে, যা রীতিবিরুদ্ধ। তবু শেষমেশ আজ থেমেই রইলাম।
৩ আগস্ট ২০০৭, শুক্রবার। সকালে ঢাকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে সাড়ে ৭টায় বিভাগীয় কমিশনারকে ফোন করলাম। স্যার ধরলেন। আমি তাঁকে গতকালের প্ল্যানমতে শুধু আজকের জন্য স্টেশনলিভের অনুরোধ জানালাম। তিনি শোনামাত্র সরাসরি নাকচ করে দিলেন। এবার আমি মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার স্যারকে ফোন দিলাম। তিনি ফোন রিসিভ করার পর আমি সব বললাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিয়ে বললেন, কমিশনারকে জানিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। কাল সকালে ফিরে এসো।
আমি এবার কমিশনারকে ফোন করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হতে অনুমতি পাওয়ার কথা জানালে, তিনি ডাইনোসরের মতো অগ্নিনিঃশ্বাস ছেড়ে এবার বললেন, ‘তাই নাকি? আচ্ছা।’ তাঁর সে নিঃশ্বাস প্রায় শত কিলো দূর থেকেই আমার কর্ণে উত্তাপ ছড়াল। মনে হলো, সেরের ওপর সোয়া সের পড়েছে। আর আমারও ভবিষ্যতে খবর আছে। আমি আমার চাকরিজীবনে এমন করে কখনও ঘোড়া ডিঙাইনি। এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আর উপায় ছিল না। (চলবে…)