স্টাফ রিপোর্টার ॥ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫৩ বছর পর শহিদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পেয়েছেন চুনারুঘাট উপজেলার বড়াইল গ্রামের ডা. অশোক চন্দ্র রায় ও মাধবপুরের উম্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অবিনাশ চন্দ্র নাগ। ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তৃতীয় দফায় ১০৮ জন শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় ৬ নম্বরেই রয়েছেন একাত্তরে ‘গরীবের ডাক্তার খ্যাত অশোক রায় এবং ৭ নম্বরে রয়েছেন অবিনাশ চন্দ্র নাগ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিনিধি হিসেবে হবিগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ গণহত্যা নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন শায়েস্তাগঞ্জের জহুর চান বিবি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন। বাংলাদেশের শহিদ বুদ্ধিজীবীগণের তালিকা প্রণয়ন এবং মুক্তি সংগ্রামে তাঁদের অবদান শীর্ষক গবেষণায় ১৬ জন বুদ্ধিজীবীর তথ্য জমা দিয়েছিলেন তিনি। তারমধ্যে হবিগঞ্জের দুইজন স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই দুইজনকে নতুন প্রজন্ম চিনেই না। ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় তালিকায় ১৪৩ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
‘গরীবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত ডা. অশোক চন্দ্র রায়ের জন্ম ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে চুনারুঘাট উপজেলার পৌর এলাকার বড়াইল গ্রামে। বড়াইল হাজী ইয়াসিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পূর্ব পাশের বাড়ীটি এখনো ‘বাবুর বাড়ী’ হিসেবে বিখ্যাত। চুনারুঘাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, চুনারুঘাট দক্ষিণাচরণ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভারতের ডিগবয় মেডিকেল কলেজে লেখাপাড়া করেন। দেশে ফিরে তিনি সরকারি হাসপাতালে চাকরি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি বিশ্বনাথ, বাহুবল, চুনারুঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেন। সর্বশেষ বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর নেন। চুনারুঘাট জন্মস্থান হলেও ডা. অশোকের পরিবার বাস করতেন হবিগঞ্জ শহরে। পুরাতন হাসপাতাল সড়কে নিজস্ব বাসা থাকলেও সে বাসা ভাড়া দিয়ে উনার পরিবার কোর্ট স্টেশনে ভাড়া থাকতেন। স্বাধীনতার পক্ষের এই মানুষটি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করার পর চুনারুঘাটের দক্ষিণ বাজার বাল্লা সড়কে যুগেশ চন্দ্র সরকারের বাসায় চেম্বার খোলেন। সেখানে নিয়মিত রোগী দেখতেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘চুুনারুঘাট সাহিত্য নিকেতন’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। বই পড়ার জন্য তাঁর চেম্বারের একটি কক্ষ ‘লাইব্রেরী’ হিসেবে ফ্রি ব্যবহার করার সুযোগ দেন সাহিত্য প্রেমিকদের। কবি দীনেশ দেবনাথের সম্পাদনা ও অলংকরণে তখন চুনারুঘাট থেকে ‘খোয়াই’ নামে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সেখানে লেখালেখি করতেন ডা. অশোক চন্দ্র রায়, ডা. রসুল, রামকৃষ্ণ পাল, ডা. কামরুল ইসলাম, শিবদাস পাল, সুধাংশু মোহন দেব প্রমূখ। মঞ্চ নাটকের একজন পৃষ্টপোষক ছিলেন তিনি। ’৬৯ এর গণ আন্দোলন ও ’৭০ এর নির্বাচনে তিনি প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেন। এনামুল হক মোস্তফা শহীদ ছিলেন এমপিএ পদে প্রার্থী। আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে ডা. অশোক তাঁর একজন কর্মী ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চুনারুঘাটের বাল্লা সড়কে ডা. অশোকের চেম্বারের সামন দিয়ে প্রতিদিন শত সহশ্র লোক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। ডা. অশোকের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব অনেকেই ভারত গেলেও দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী ডা. অশোক দেশে থেকে যান অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য। নিজের জীবনের চিন্তা না করে একাত্তরের কঠিন দুর্দিনে তিনি মানুষের পাশে ছিলেন। প্রতিদিনের মতো ১১ মে চেম্বারে রোগী দেখছিলেন ডা. অশোক চন্দ্র রায়। স্থানীয় দালালদের পরিকল্পনায় পাক বাহিনী হানা দেয় সেখানে। অশোক চন্দ্র রায়, বাড়ির মালিক যোগেন্দ্র সরকার, মহেন্দ্র সরকার ও জিতেন্দ্র সরকারকে ধরে নিয়ে যায় চুনারুঘাট উত্তর বাজার খোয়াই নদীর তীরে। সেখানেই তাদের গুলি করে লাশ ফেলে দেয় নদীর পানিতে। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে আহত অবস্থায় বেঁচে যান জিতেন্দ্র সরকার। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহিদ অশোক চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শেফালী প্রভা রায়কে সমবেদনা ও সহানুভূতি জানিয়ে একটি পত্র দেন। ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে শহিদ পরিবারের সাহায্যার্থে দেয়া হয় দুই হাজার টাকা। চেক নম্বর সিএ ০১৭৭৭৮। শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. অশোক চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শেফালী প্রভা রায় স্বামীর শোকে ১৯৭২ সালেই মৃত্যুবরণ করেন। ডা. অশোকের তিন ছেলের মধ্যে অজিত কুমার রায় ছিলেন আইনজীবী। সুজিত কুমার রায় ও রঞ্জিত কুমার রায় ব্যাংকার হিসেবে কর্মজীবন শেষ করে অবসরে আছেন। তিন মেয়ে অঞ্জলী প্রভা রায়, লীলা রায় ও লক্ষ্মী মনি রায়। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। লীলা রায় চুনারুঘাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। পিতৃশোকে ২ ভাই ও ২ বোন চিরকুমার হিসেবে জীবনযাপন করছেন। একাত্তরে পরিবারের লোকজন ভারতে পালিয়ে গেলে তাঁদের ঘরবাড়ি রাজাকাররা দখল করে নেয়। পিতাকে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্তির জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল বরাবর আবেদন করেও পুত্র সুজিত কুমার রায় কোনো সদুত্তর পাননি। অবশেষে পেলেন শহিদ বুদ্দিজীবীর স্বীকৃতি।
মাধবপুরের আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক অবিনাশ নাগকে তাঁর নিজ বাড়ী দক্ষিণ বেজুড়ায় হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। বাড়ির সকলে ভারত চলে গেলেও ছাত্র-ছাত্রী, প্রিয় শিক্ষাঙ্গন তথা জন্মভূমির কথা চিন্তা করে নিজ বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন তিনি। অবিনাশ চন্দ্র নাগের জন্ম ১৯৭১ খ্রি. এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি মাধবপুর আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর পারিবারিক সিদ্ধান্তে তিনি ভারত চলে যান। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় তিনি মেঘলিবন চা বাগানে অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি নেন। ১৯৪৭ খ্রি. দেশ বিভাগের পর তিনি চা বাগানের চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৪৮ খ্রি. ৮ মে তিনি পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে যোগ দেন। নৌ বাহিনীর যোগাযোগ বিভাগে টেকনিক্যাল অপারেটর হিসেবে ১৫ বছর চাকরি করে ১৯৬৩ খ্রি. তিনি অবসরগ্রহণ করেন। নৌ বাহিনীর চাকরিকালে তিনি বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এ সময় তিনি অস্ত্র চালনা, বেতার যন্ত্রপাতি পরিচালনা, নেতৃত্ব দানে প্রশংসা অর্জন করেন এবং পদক লাভ করেন। তিনি মাল্টা, মিশর, এডেন, কলম্বোসহ পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ১৯৬৩ খ্রি. তিনি আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি বিদ্যালয়ের হিসাব রাখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শরীরচর্চা শিখাতেন এবং ইংরেজি পড়াতেন। বেসরকারী বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী এমপি, মাধবপুরের সাবেক পৌর মেয়র শাহ মোহাম্মদ মুসলিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুকমল রায় প্রমুখ তাঁর ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রি. পাক ভারত যুদ্ধকালে তিনি শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের যুদ্ধকালীন আত্মরক্ষামূলক পরিখা খনন, ব্ল্যাট আউট, আহত রোগী স্থানান্তর ও সেবা প্রদান সম্পর্কে নানা কলা কৌশল শিক্ষা দেন। যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালে উপকারে আসে। মা ও মাতৃভূমির প্রতি দরদী অবিনাশ ভাষা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং অসহযোগ আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ট কর্মী। ৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে মৌলানা আছাদ আলীর পক্ষে কাজ করেন। নিজের কর্মস্থল আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের তিনি স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে মাধবপুর উপজেলায় উন্মেতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় পাকিস্তান বিরোধী এক ঘাটিতে পরিণত হয়। ফলে এ বিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পিতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শহিদ অবিনাশ নাগের বড় ছেলে অরুন কুমার নাগ ’৬৯ এর গণ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। গ্রামবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে তখনকার সময়ে গ্রামের একমাত্র রেডিওটি প্রতি রাতে তিনি মানুষকে শুনাতেন। ১৯৭১ খ্রি. মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যরা প্রাণভয়ে ভারতে চলে গেলেও দেশপ্রেমিক অবিনাশ দেশ ছাড়তে রাজি হননি। কিভাবে গ্রামের মানুষ আত্মরক্ষা করবে বা আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ গড়বে এসব বিষয়াদি নিয়ে গ্রামের মানুষের সাথে তিনি পরামর্শ করেন। ২৭ এপ্রিল প্রথম মাধবপুর আক্রান্ত হবার দিন তিনি পরিবার ও গ্রামের মানুষকে ভারত সীমান্তে পৌঁছিয়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যাবার মানসিক প্রস্তুতি নেন। দুর্ভাগ্য ঐদিনই স্থানীয় রাজাকারের ঈশারায় পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁকে ধরে ফেলে। দক্ষ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশপ্রেমিক অবিনাশ নাগকে ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে সড়কের পাশে পেছনে হাত বেঁেধ জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে মাথায় বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয় অবিনাশ নাগকে। তিনদিন পর্যন্ত লাশ সেখানেই পড়েছিল, ভয়ে কেউ কাছে যায়নি। পাকিস্থানী বাহিনীর টহল কমলে গ্রামের কয়েকজন সেখানে লাশটি মাটি চাপা দেন। স্বাধীনতার পর পারিবারিক শশ্মানে সেখান থেকে উঠিয়ে তাঁর দেহাবশেষ সমাহিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করায় দক্ষিণ বেজুড়া গ্রামে পাকিস্থানী বাহিনী গণহত্যা চালায় এবং আরো ছয়জন নিরীহ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করে। শহিদ অবিনাশের বাড়িসহ অধিকাংশ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তারা। শহিদ অবিনাশসহ গ্রামের শহিদদের স্মরণে ২০১৭ খ্রি. একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। শহিদ অবিনাশ নাগের পাঁচ ছেলে অরুন কুমার নাগ, অসিত কুমার নাগ, অমল কুমার নাগ, অনল কুমার নাগ, অলক কুমার নাগ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।