(মোঃ আতাউর রহমান ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই বছর হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন। হবিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। তাঁর সেই ডায়েরিতে ফুটে উঠেছে হবিগঞ্জের বৈচিত্রময় চিত্র। দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার পাঠকদের জন্য তাঁর ডায়েরি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে-)

পশ্চাৎপদ লাখাইবাসীদের নিয়ে গর্বের কোনো শেষ নেই
আতাউর রহমান কানন

‘নিশিথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’ জনপ্রিয় এই গানটির গীতিকার মরমী সাধক শেখ ভানু শাহের মাজার লাখাই উপজেলার বামৈ ইউনিয়নের ভাদিকারা গ্রামে। এছাড়া বিশ্ব শান্তি ও এক বিশ্ব ভ্রাতৃরাজ্যের প্রচারক ঠাকুর দয়ানন্দ দেব, কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম বাঙালি অ্যাটর্নি জেনারেল ও বাঙালি বিচারপতি তারা কিশোর চৌধুরী (১৮৫৯-১৯৩৫) এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার চন্দ্র শেখর রায়ের বাড়িও লাখাই উপজেলায়।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। সকাল ৯টায় মাধবপুর উপজেলা হেডকোয়ার্টারে যাই। সেখানে ঢাকা থেকে আগত অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানকে রিসিভ করি। তিনি হবিগঞ্জ এসে তাঁর পূর্বনির্ধারিত ৭টি প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এরপর জেলায় নবনির্মিত বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সুধীসমাবেশে ভাষণ দেন। ইতঃপূর্বে হবিগঞ্জে এনডিসি হিসেবে চাকরি করাকালীন আমি তাঁর পূর্বপরিচিত। তাঁর অনেক প্রোটোকল করেছি এবং তাঁরই ফরমায়েশ অনুযায়ী বানিয়াচং হাওরের রুই, পরিযায়ী পাখি আর হবিগঞ্জের শংকরের ঘানির খাঁটি সরিষার তেল বাসায় পৌঁছে দিতে ভুল করিনি। আজ যখন ডিসি হয়ে হবিগঞ্জ তথা সিলেট বিভাগের প্রবেশদ্বার হিসেবে অভিহিত মাধবপুরে প্রথম তাঁকে রিসিভ করি, তখন তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে তুলে পাশে বসিয়ে প্রথমেই বলেন, জয়েন করছনি এনডিসি?
-আমি অতি মোলায়েম স্বরে উত্তর করলাম, জি স্যার।
-বালা। তোমার দেশের বাড়ি খই?
-স্যার, ঢাকায়।
-বালা। ঢাকার মানুষ খুউব বালা। দেইখ্যা শুইন্যা কাজ করবা। আমাদের লোকগুলারে বেশি ফালাফালি করতে দিবা না।
গাড়ির সামনের আসনে বসা হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও জেলা বিএনপির সেক্রেটারি জি কে গউছ তখন বলে উঠেন, আমাদের নতুন ডিসি সাব হবিগঞ্জে আগে থেকেই খুব জনপ্রিয় বালা মানুষ। আশা করি তাইনে বালা করবা।
উনারা বালাই থাকেন। তোমরাই ঝামেলা পাকাও। তোমার লোকজনকে সাবধান খইরা দিবা।
এরপর নানারকম কথায় কথায় আমরা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছি। অনুষ্ঠান শেষে সার্কিট হাউজে লাঞ্চের সময় তাঁর প্রিয় মুখিকচু দিয়ে কই মাছের ঝোল দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি আমাকে বললেন, এনডিসি তুমি আমার প্রিয় তরকারির কথা মনে রেখেছ দেখছি! আমার মা এই তরকারিটা খুউব বালা রানতো।
অর্থমন্ত্রী বিকেল ৩টায় লাঞ্চ শেষে সালামি নিয়ে মৌলভীবাজার চলেন গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, তোমাকে ডিসি বলতে গিয়া বারবারই এনডিসি বলছি, কিছু মনে খইরো না।
আমি শুধু মিটমিটিয়ে একটু হাসলাম।
পরের দিন শুক্রবার, সারাদিন বাসাতেই কাটাই। সন্ধ্যার পর শারদীয় দুর্গাপূজা পরিদর্শনে বের হই। আজ পূজার সপ্তমী। হবিগঞ্জে আগের চেয়ে বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পূজা হচ্ছে বলে মনে হল। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার উদ্ভব হয়নি। আমার আগমনে পূজা কমিটির লোকজন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। শহরের যে মন্ডপেই যাই- কমবেশি আপ্যায়িত হতে হয়। পূজা দেখে রাত ১০টায় বাসায় ফিরে আসি।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৬, শনিবার। বিকেলে বানিয়াচং এলাকায় পূজা দেখতে যাই। সেখান থেকে রাত সাড়ে আটটায় বাসায় ফিরে দেখি উপসচিব বিডি মিত্র ভাবিসহ আমার বাসায় বসে আছেন। তাঁর বাড়ি শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায়। তিনি আমার পূর্বপরিচিত। কুমিল্লাতে আমি যখন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম, তখন সেই জেলার বরুড়া উপজেলার তিনি ইউএনও ছিলেন। এছাড়া তিনি আমার ঢাকা কলেজের ব্যাচমেট। তাঁদের সাথে সৌজন্য আলাপচারিতা হলো। আমাকে পূজার দাওয়াত দিয়ে চলে গেলেন।
পরের দিন রবিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করি। এরপর বাসায় এসে খানিকক্ষণ রেস্ট নিয়ে সন্ধে ৭টায় স্টাফ অফিসারসহ শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায় পূজা দেখতে দেখতে সবশেষে বিডি মিত্রের গ্রামের বাড়িতে যাই। বেশ বড় বাড়ি। বাবা-কাকারা সব পাশাপাশি বাস করেন। পারিবারিকভাবে পূজার আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের জন্য ডিনারের আয়োজন ছিল। সেখান থেকে রাত ১০টায় ডিনার সেরে বাসায় ফিরে আসি।
২ অক্টোবর, ২০০৬, সোমবার। আজ দুর্গাপূজার দশমী উপলক্ষ্যে সরকারি বন্ধ। কিন্তু আজ বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ শুরু। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য সাড়ে ১১টায় জেলা শিশু একাডেমিতে যাই। র‌্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে ২টায় বাসায় ফিরে আসি।
বিকেল থেকে শহরের সব পূজামন্ডব সারা শহর প্রদক্ষিণ করে খোয়াই নদীতে নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। যে কোনো অপ্রীতিকর অঘটন প্রতিরোধের জন্য কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ টিম গঠন করে দিই। রমজান মাস বিবেচনায় সন্ধ্যার আগেই সব বিসর্জনের কাজ শেষ হয়।
৩ অক্টোবর ২০০৬, মঙ্গলবার। সকাল ৯টায় অফিসে যাই। অফিসের কাজকর্ম করে ১১টায় লাখাই উপজেলায় গিয়ে পূর্বনির্ধারিত মতবিনিময় সভায় যোগদান করি। আমি জেলায় যোগদানের পর জেলার উপজেলাসমূহে সৌজন্য ভিজিট উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট উপজেলার কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে মতবিনিময় সভা করার জন্য প্রোগ্রাম প্রেরণ করি। সেই প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে আজ লাখাই উপজেলায় সফর করি। এখানের মতবিনিময় সভায় এলাকার গণ্যমান্য লোকজন নানা সমস্যার বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু গর্বের বিষয়ও উল্লেখ করেন। জেলার অন্যান্য উপজেলার তুলনায় দরিদ্রতম এই জনপদের নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। ধান আর মাছ এলাকার মানুষের প্রধান আয়ের উৎস। এছাড়া ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এদের হোটেল ব্যবসা রয়েছে। আর ঢাকার অধিকাংশ হোটেলের কর্মচারী তো এই লাখাইবাসী। বেল্ট আর ভাঙাড়ির মালের ব্যবসাতেও এদের প্রাধান্য রয়েছে। বৃহত্তর সিলেট এলাকার লোকজন যেমন অধিকাংশই ইংল্যান্ড-আমেরিকা প্রবাসী, এখানের লোক তেমন একটা নন। তবে এখানের একটি গ্রামের লোক গ্রিসে বেশি প্রবাসী হওয়ায় ওই গ্রামকে ‘গ্রিস গ্রাম’ বলা হয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত নিচু বিলঝিল এলাকা হওয়ায় রাস্তাঘাট তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে এক সময়ের দুর্গম এই উপজেলা সদরে এখন বারোমাসই গাড়িতে যাতায়াত করা যায়।
অনেক মনীষী এ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। হযরত শাহজালাল (র.) এর সমসাময়িক ৩৬০ আওলিয়াদের একজন হযরত বায়েজীদ শাহ প্রায় ৭০০ বছর আগে বুল্লায় আশ্রয় নিয়ে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। তাঁর নামে বুল্লা বাজারে একটি মাজার রয়েছে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও গায়ক শচীনদেব বর্মনের কন্ঠে গীত ‘নিশিথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’ জনপ্রিয় এই গানটির গীতিকার মরমী সাধক শেখ ভানু শাহের মাজার আছে এ উপজেলার বামৈ ইউনিয়নের ভাদিকারা গ্রামে। এছাড়া বিশ্ব শান্তি ও এক বিশ্ব ভ্রাতৃরাজ্যের প্রচারক ঠাকুর দয়ানন্দ দেব, কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম বাঙালি অ্যাটর্নি জেনারেল ও বাঙালি বিচারপতি তারা কিশোর চৌধুরী (১৮৫৯-১৯৩৫) এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার চন্দ্র শেখর রায়ের বাড়িও এই লাখাই উপজেলায়। পশ্চাৎপদ এই লাখাইবাসীদের নিয়ে কিন্তু গর্বের কোনো শেষ নেই!
সুন্দর একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আয়াতুল ইসলামকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি বিকাল ৩টায় সদর দপ্তরে ফিরে আসি।
পরের দিন সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে বসি। আমার অফিসের লোকজন এখন আমার দেখাদেখি ৯টা কিংবা তার আগেই অফিসে চলে আসেন। জাস্ট টাইমে অফিসে আসা আমার আগেরই অভ্যাস। ডিসিরা শত ব্যস্ততায় থাকেন বিধায় এই সময় নাকি ঠিক থাকে না। তবে আমার কারণে এর ব্যত্যয় না ঘটাতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অফিসের জরুরি কাজ করে এবং অন্যান্য কাজের খোঁজখবর নিয়ে আমি সকাল ১১টায় বানিয়াচং উপজেলার উদ্দেশে বেরিয়ে গেলাম। সেখানে আজ সাড়ে ১১টায় সৌজন্য মতবিনিময় সভার প্রোগাম রয়েছে। সেখান থেকে আজই আবার একইরূপ সভায় বিকাল দুটায় নবীগঞ্জ গিয়ে যোগদান করার কথা। আমার উদ্দেশ্য হলো- অক্টোবরের প্রথমার্ধেই সবকটি উপজেলায় আমার যোগদান উপলক্ষ্যে আয়োজিত সৌজন্য মতবিনিময় সভা শেষ করা। এরপর কেয়ারটেকার সরকার গঠিত হলে নির্বাচনী কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। (চলবে…)