রুবেল দিরাইয়ে নিজের নাম পরিবর্তন করে মাসুদ রানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ॥ সেখানে এক মেয়ের সাথে তার বিয়ের প্রস্তুতি চলাকালে র‌্যাব তাকে গ্রেফতার করে ॥ গ্রেফতারকালে তার হাতে ছিল গায়ে হলুদের মেহেদী

এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিন হত্যা মামলার আসামী রুবেল মিয়াকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় র‌্যাব-৯ এর একটি টিম বিশেষ টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে। আটককৃত রুবেল মিয়া ধল গ্রামের মৃত রহমত আলীর ছেলে।
র‌্যাব সূত্র জানায়, রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিন নিহত হওয়ার পর থেকে আটককৃত রুবেল মিয়া পলাতক ছিল। সে নাম পরিবর্তন করে মাসুদ রানা নামে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরী করে দিরাইয়ে শান্তিপুর গ্রামে আশ্রয় নেয়। নিজের নাম রুবেল মিয়া হলেও সেখানে মাসুদ রানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মঙ্গলবার রাতে যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে রুবেল মিয়া সেই বাড়ির এক মেয়ের সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে বিকেলে রুবেল মিয়া ও তার হবু স্ত্রীর হাতে গায়ে হলুদের মেহেদী পড়ানো অবস্থায় র‌্যাব রুবেল মিয়াকে আটক করে।
নিহত স্কুলছাত্রী জেরিনের চাচাত ভাই শিক্ষানবীশ আইনজীবী আব্দুল মুবিন মিজান জানান, ঘটনার পর থেকে ঘাতক জাকিরের বন্ধু রুবেল মিয়া পলাতক ছিল। অবশেষে র‌্যাব তাকে আটক করেছে। এ জন্য আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে র‌্যাব-৯ এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
মামলার বিরবণে জানা যায়, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আব্দুল হাই’র মেয়ে এবং রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০২০ সালের এসএসসি পরিক্ষার্থী মদিনাতুল কুবরা জেরিনকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল একই গ্রামের জাকির হোসেন। কিন্তু জেরিন তার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে প্রায় সময় উত্ত্যক্ত করতো জাকির। এই বিষয়টি জেরিনের বাবা জাকির হোসেনের পরিবারকে অবগত করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেরিনকে অপহরণের পরিকল্পনা করে জাকির। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নূর আলমের সিএনজি অটোরিক্সায় করে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল জেরিন। আগে থেকেই গাড়িতে ছিল রুবেল। পথিমধ্যে সিএনজি অটোরিক্সাতে তোলা হয় জাকিরকে। সিএনজি অটোরিকশটি জেরিনের স্কুল পেরিয়ে গেলেও তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়নি। এ সময় নামার চেষ্টা করলে জেরিনের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হয় অপহরণকারীদের। এক পর্যায়ে সিএনজি অটোরিকশা থেকে জাকির তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে জেরিনের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জানুয়ারি সকালে মারা যান জেরিন। প্রথমে এ ঘটনা দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে পুলিশ এ ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জাকিরকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে কবর থেকে জেরিনের লাশ উত্তোলন করে ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। এর আগে জেরিনের বাবা আব্দুল হাই বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ প্রেক্ষিতে মামলার প্রধান আসামী জাকির হোসেন ও নূর আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জাকির হোসেন ও নূর আলম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার তৎকালীন ওসি মোঃ মাসুক আলী ২০২১ সালের ১৮ মার্চ আদালতে জাকির হোসেন, নূর আলম ও রুবেল মিয়ার বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন। এ মামলায় ২১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর আসামী জাকির হোসেনের উপস্থিতিতে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক সুদীপ্ত দাস জেরিন হত্যা মামলায় দুই আসামীর ফাঁসির আদেশ দেন। একই সাথে তাদের দেড় লাখ টাকা করে জরিমানা করেন। দন্ডিতরা হলো- হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের দিদার হোসেনের ছেলে জাকির হোসেন (২৫) ও পাটলী গ্রামের আব্দুল হাই’র ছেলে সিএনজি চালক নূর আলম। মামলার আসামী রুবেল মিয়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার শিশু আদালতে তার বিচারকার্য চলমান রয়েছে। সম্প্রতি ওই মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী সিএনজি অটোরিকশা চালক নূর আলম আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।