ইসলামের ইতিহাসে এবং মিল্লাতে ইবরাহীমের সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগের ইবাদাত হচ্ছে কুরবানী। মহান আল্লাহর পরীক্ষায় এক এক করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হবার পরে নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন হযরত ইবরাহীম আ.। সুতরাং কুরবানী গতানুগতিক কোন ইবাদাত বা কাজ নয়। বরং আল্লাহর এক এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে সবশেষে যে পরীক্ষায় চূড়ান্ত সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন, মুসলমান ডিগ্রিটি প্রদান করেছেন-সেটার নাম কুরবানী। কুরআনের ভাষায় হযরত ইবরাহীম আ. কে ডাক দিয়ে এ ঘোষণাই দিয়েছেন মহান আল্লাহ-
‘তুমি স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটা হচ্ছে স্পষ্ট চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা’ (সুরা সাফফাত। আয়াত, ১০৪, ১০৫)। এ ছাড়া সুরা হাজ্জ এর ৩৭ নাম্বার আয়াতে আরো শক্ত ঘোষণা এসেছে যে, আল্লাহর কাছে উহার রক্ত, মাংস কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। সুতরাং যে বান্দাহর অন্তরে তাকওয়া আছে, আল্লাহে সন্তুষ্টির জন্যই যিনি কুরবানী দিবেন তিনি অবশ্যই কুরবানীর নিয়ম কানুন জেনে নিবেন। পশু জবাই করলেই কুরবানী আদায় হয় না। গোশত খাওয়ার জন্য সারা বছরই পশু জবাই করি, তা কি কুরবানী? সুতরাং কুরবানী গোশত খাওয়ার নিয়তে নয়, এমনকি ভাগীদারদের কেউ যদি মনের মধ্যে গোশত খাওয়ার নিয়ত লালন করে, তবে ঐ পশুতে অংশগ্রহণকারী কারো কুরবানীই আদায় হবে না। হযরত ইবরাহীম আ. তার প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইল আ. কে কুরবানী করে আল্লাহর কাছে মাকবুল হয়েছিলেন। তিনি কিন্তু পশু কুরবানী করতে গিয়েছিলেন না। তাই একটি পশু জবাই করে দিলেই আমার কুরবানী হবে না। অবশ্যই এর যাবতীয় নিয়ম কানুন পুরা পুরা পালন করতে হবে।
স্বাধীন বালেগ, আকেল, নিসাবের মালিক, মুকিম মুসলমানের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। রাসুল স. ইরশাদ করেছেন- সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না, সে যেন আমাদের ইদগাহের ধারে কাছে না আসে। সামর্থ্য ছাড়া ঋণ করে কুরবানী করার অনুমতি চাইলে নবীজী তাকেও বললেন- দাও, আল্লাহ ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিবেন। যে কুরবানীর পশুর প্রতিটি লোমের বিনিময়ে অগণিত নেকী দান করা হবে, পশুটি পুলসিরাতের বাহন হয়ে হাজির হবে- এরূপ বহু ফজীলত কি গোশত খাওয়ার জন্য? আগের যুগে কুরবানীর পশুর গোশত খাওয়ার হুকুম ছিল না। আসমান থেকে আগুন এসে পশুটিকে জ্বালিয়ে দিত। উম্মতে মুহাম্মাদিকে গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়ে আরো অনুগ্রহ করা হয়েছে। তাই আসুন, আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহের শুকরিয়া-স্বরূপ আমরা সঠিকভাবে কুরবানী করি।
কোন গরীব লোক ১ম দিনে কুরবানী করার পরে ২য় বা ৩য় দিনে যদি নিসাবের মালিক হয়, তাহলে এখন তার ওয়াজিব আদায়ের জন্য আবার কুরবানী করতে হবে। গরীব লোক যদি একটি পশু কিনে কুরবানী করার আগেই হারিয়ে যায়, এরপর অন্য একটি পশু কিনে কুরবানী করার পরে আগের পশুটি পেয়ে যায়- তবে সেটিও কুরবানী করে দিতে হবে। নিসাবের মালিকের ক্ষেত্রে এরূপ ঘটলে তাকে শেষের পশুটি কুরবানী করার প্রয়োজন পড়বে না। নিজের পশু অন্যের নামে কুরবানী দিয়ে দিলে তাতে সে নামের ওয়াজিব আদায় হবে না। কুরবানী দাতাকে পশুর মালিক হতে হয়। কুরবানীর পশুটি জবাই না করে যদি সম্পূর্ণ দান- সদকা করে দেয়, তাতে কুরবানীর ওয়াজিব আদায় হবে না। মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করলে কুরবানীদাতার ওয়াজিবও তাতে আদায় হয়ে যাবে।
যে সব পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ তা হচ্ছে, উট, নর মাদী। গরু- মহিষ, নর মাদী। ছাগল জাতীয় পশু এর মধ্যে ভেড়া, দুম্বা, মাদী, খাসী সবই অন্তর্ভুক্ত। যে সব পশু গৃহপালিত জাত নয়, তা দিয়ে কুরবানী হবে না। যেমন: হরিণ, নীল গাই বা অন্য হালাল প্রাণী। গরু মহিষ পূর্ণ দুই বছর, উট পূর্ণ পাঁচ বছর এবং ছাগল পূর্ণ এক বছর বয়সের হতে হবে। বয়স নির্ণয় দাঁত দেখে নয়, বরং দিন, মাস, বছর গণনা দ্বারাই স্থির করতে হবে। তবে ছয় মাসের ভেড়া বা দুম্বা যদি এক বছর বয়সের ভেড়া, দুম্বার মতই মোটা-তাজা দেখায়, তা দিয়ে কুরবানী জায়েজ হবে। গরু, মহিষ, উটে সাতজন পর্যন্ত অংশগ্রহণ করতে পারবে। অংশীদারদের গোশত অনুমান করে ভাগ করলে হবে না। ওজন করে সমান ভাবে ভাগ করতে হবে। এর পরও একে অপরের কাছ থেকে দাবী না রাখার ক্ষমা চেয়ে নিবে।
যে পশুর শিং জন্মগতই নেই কিংবা অর্ধেক ভেঙে গেছে, তা দিয়ে কুরবানী বৈধ হবে। কান লেজের বেলাও এরূপ হুকুম। অর্থাৎ, অর্ধেকের পরিমাণ থাকলে কুরবানী বৈধ হবে, আর অর্ধেকের বেশি কাটা গেলে বা না থাকলে হবে না। অন্ধ, কানা, অতি দুর্বল বা চর্মরোগের কারণে এত দুর্বল যে, জবাইয়ের স্থান পর্যন্ত হেঁেট যেতে পারে না- এমন পশু দিয়ে কুরবানী হবে না। জিহ্বা ও দাঁতের হুকুম এরূপ যে, যদি খাদ্য গ্রহণে অসুবিধা না হয়, তবে জায়েজ। আর যদি খাদ্য খেতে পারে না, সমস্যা এতদূর গড়িয়েছে, তাহলে কুরবানী হবে না। পঙ্গু পশু যদি তিন পায়ে ভর করে চলে ৪র্থ পা সামান্য মাটিতে লাগায় তাহলে কুরবানী হবে। আর যদি চতুর্থ পা মোটেও মাটিতে লাগে না, বা লাগাতে পারে না, তাহলে কুরবানী হবে না। খাসী করা অর্থাৎ অন্ডকোষ ফেলে দেয়া পশু জায়েজ এবং উত্তম। ফতোয়ায়ে আলমগীরী। ৫ম খন্ড, পৃ: ২৮৫। বুখারী শরীফের ১৫৫১ নাম্বার হাদীসে এসেছ-
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় কুরবানীর দুটি খাসী করা ভেড়া জবেহ করলেন।’
কুরবানীর পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। অন্যকে দিয়ে জবাই করালে কিংবা গোশত বানালে তার পারিশ্রমিক আলাদা দিতে হবে। গোশত দিয়ে কখনোই পারিশ্রমিক দেয়া যাবে না। কুরবানী দাতা গোশত, হাড়, শিং, খুড় বা অন্য কিছু বিক্রি করতে পারবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। যেমন চামড়ার মূল্য। কিন্তু চামড়া যদি নিজে ব্যবহার করে তাহলে অসুবিধা নেই। এরূপ পশুর রশি, গদি, পোশাক ইত্যাদিও ব্যবহার করতে পারবে। জবাইকারী এবং এ কাজে অংশগ্রহণকারী সবাই ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পাঠ করবে। মেশিন দিয়ে জবাই করলে সুইচ টিপার সময় পাঠ করবে। জবেহ করার সময় সুবাহানাল্লা, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি পাঠ করলে হবে না। অর্ধেক জবাই করার পরে পশু ছুটে, বা পালিয়ে গেলে পুনরায় জবাই করার সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার পাঠ করতে হবে। কিন্তু ছুরি চাকু পরিবর্তন করলে পুনরায় বিসমিল্লাহ পাঠ না করলেও চলবে। রাতের বেলায় জবাই করা মাকরুহ। জিলহজ্জের ১২ তারিখ দিবাগত রাতেও যদি কুরবানী করে তাতেও কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার আগে জবাই করলে কুরবানী হবে না। কোন এলাকায় যদি একাধিক জামাত হয়, তাহলে একটি জামাত শেষ হলেই এলাকার যে কেউ কুরবানী করতে পারবেন। জামাত শেষ হবার পরে যদি জানা যায় যে, নামাজ ভুল হয়ে ফাসেদ হয়ে গিয়েছে, তাহলে লোকজন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার পূর্বেই আবার দোহরায়ে পড়ে নিতে হবে। আর যদি লোকজন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, ডেকে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে যারা কুরবানী করে ফেলেছে- তাদেরটা আদায় হয়ে যাবে। জবাইকারীকে কিবলামুখী হওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং পশুকে কিবলামুখী করা মুস্তাহাব। জবেহের সময় চারটি রগ কাটতে হয়। শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও এর দুপাশে দুটি মোট রক্তের রগ। এর মধ্যে (অধিকাংশ) তিনটি কাটা পড়লে জবেহ বৈধ হবে।
কুরবানীর সাথে আকিকা দিতে কোন বাধা নেই। সুন্নাত আকিকার গোশতের হুকুম কুরবানীর গোশতের মতই। তবে মান্নত আকিকা ওয়াজিব এবং এর গোশত সদকা করে দিতে হয়। কুরবানীর গোশত তিন ভাগের এক ভাগ গরীবদেরকে, এক ভাগ আত্মীয়দেরকে এবং এক ভাগ নিজে রাখা সুন্নাত। এর ব্যতিক্রম করলে অন্যায় হবে না। এখন কুরবানীর গোশত তিন দিনের বেশী রাখতে নিষেধ নেই। চাকর বাকর বা কর্মচারীদেরকে যদি শুধু কুরবানীর গোশত দিয়েই খাবার খাওয়ানো হয়, তাহলে সে গোশতের সমমূল্য সদকা দিতে হবে। কিন্তু যদি গোশতের সাথে অন্য তরি তরকারীর সাথে গোশতও দেয়া হয় তাহলে কিছু করতে হবে না। এরূপ বহু নিয়ম কানুন কুরবানী বিষয়ে আমাদের জানা দরকার। আমাদের কোন অবহেলায় কুরবানীর সীমাহীন সাওয়াব বিনষ্ট যেন না হয়ে যায়- সে দিকে আল্লাহ আমাদের সবাইকে খেয়াল রাখার তাওফিক দান করুন। আমীন। সূত্র: ইন্টারনেট
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com