সঞ্জিত রায় দৃঢ়তার সাথে বললেন, আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করার পর ছুরি দিয়ে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা আমির আলী এই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে

এসএম সুরুজ আলী ॥ বাহুবলের দিগাম্বর বাজারে গভীর রাতে মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যার ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। আজ অথবা আগামীকাল এ হত্যাকান্ডের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করবে পুলিশ। তবে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা দৈনিক হবিগঞ্জের মুখকে জানান, মা মেয়ে হত্যার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। আমাদের আরো কিছু কাজ বাকি রয়েছে, সেই কাজগুলো শেষ হলেই আজ অথবা আগামীকাল সাংবাদিকদের হত্যার রহস্য জানিয়ে দেয়া হবে। তবে এ ঘটনায় কয়জনকে আটক করা হয়েছে, এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে চাননি। একটি সূত্র জানিয়েছে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ।
এদিকে শুক্রবার বিকেলে দ্বিগাম্বর লামাপুটিজুরী শ্মশানে একই চিতায় দাহ করা হয়েছে মা অঞ্জলী মালেকার ও তার মেয়ে পূজা রায়কে। তাদের মুখাগ্নি করেন সঞ্জিত রায়ের প্রথম পক্ষের সন্তান সৌরভ রায়। এ সময় অনেক লোকজন শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন এবং চোখের জল ফেলেন। সেখানে শুধু সনাতন ধর্মালম্বীরাই ছিলেন না, মুসলিমরাও উপস্থিত ছিলেন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় ওই এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পুরো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে অঞ্জলী মালেকারের ও পূজা রায়ের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হবিগঞ্জ আড়াইশ’ শয্যা জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে আনা হয়। পরে মেডিকেল বোর্ড করে শুক্রবার সকালে দুই মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। মা ও মেয়েকে হত্যার পূর্বে ধর্ষণ করা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মুমিন জানান, ময়নাতদন্তের বিষয়ে কিছু বলার নিয়ম নেই। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কি-না তার জন্য আমরা উভয়ের আলমত সংগ্রহ করেছি। এগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ফলাফল জানা যাবে।
নিহত অঞ্জলীর স্বামী সঞ্জিত রায় জানান, তারা এখনও মামলা দায়ের করেননি। তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় মামলা দায়ের করা হবে।
বাহুবল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নেহার রঞ্জন দেব বলেন, আমরা এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে আমরা তাদের ফাঁসি চাই।
বাহুবল থানার ওসি তদন্ত আলমগীর কবির জানান, আমরা শীঘ্রই আপনাদেরকে ভাল খবর জানাতে পারব। কারণ রহস্য উদঘাটনের পথে এবং মামলাও প্রক্রিয়াধীন। কাউকে আটক করা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশ কয়েকজনকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ ও যাচাই বাছাই চলছে।
একটি সূত্র জানায়, ঘটনার মূল নায়ক ও আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া সঞ্জিত দাসের প্রতিবেশী কাঁচামালের শ্রমিক আমীর আলী পুলিশের হেফাজতে থেকে সহযোগীদের নাম প্রকাশ করেছে। এছাড়াও তার ফোনের কল লিস্ট থেকেও সন্দেহভাজনদের সনাক্ত করে আমীর আলীসহ ৫জন এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিংকালে সকল তথ্য প্রকাশ করবে। আমীর আলীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণেরও চেষ্টা চলছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার ভোররাতে বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী ইউনিয়নের দ্বিগাম্বর বাজারে লামাপুটিজুরী গ্রামের সঞ্জিত রায়ের স্ত্রী অঞ্জলী মালেকার (৩৫) ও তার মেয়ে পূজা দাস (৮) এর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ধর্ষণের পর এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সঞ্জিত দাস কাঁচামালের ব্যবসা করেন। তিনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে দ্বিগাম্বর বাজারে তিন তলা একটি বাসায় ভাড়াটে হিসাবে বসবাস করছিলেন। ঘটনার রাতে তিনি ব্যবসার কাজে সুনামগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি বাসায় এসে স্ত্রী ও মেয়ের গলাকাটা লাশ দেখতে পান।
বাহুবল থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, বৃহস্পতিবার ভোররাতে পুটিজুরী ইউনিয়নের দ্বিগাম্বর বাজারের একটি তিনতলা ভবন থেকে ভাড়াটিয়া সঞ্জিত দাশের স্ত্রী অঞ্জলী মালাকার (৩৫) ও তার কন্যা পূজা রায় (৮) এর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত অঞ্জলীর স্বামী সঞ্জিত রায় স্থানীয় দ্বিগাম্বর বাজারের সবজি ব্যবসায়ী। তিনি স্ত্রী-কন্যা নিয়ে ওই ভবনের ৩য় তলায় বসবাস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি একই ইউনিয়নের লামাপুটিজুরী। তার কন্যা নিহত পূজা দাশ স্থানীয় কালিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন তারা মিয়া ও স্থানীয় দ্বিগাম্বর বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, উক্ত তিনতলা ভবনের ৩য় তলায় স্ত্রী-কন্যা নিয়ে সবজি ব্যবসায়ী সঞ্জিত রায় এবং ২য় তলায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন সবজি আড়তের শ্রমিক সিলেটের বাসিন্দা আমির আলী (৩৫)। ৩য় তলার বাসিন্দা সঞ্জিত রায় গত বুধবার (১৭ মার্চ) সবজি আনতে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলেন। অপরদিকে, ২য় তলার বাসিন্দা আমির আলীর স্ত্রী-সন্তানও ২/৩ দিন আগে অন্যত্র বেড়াতে গিয়েছে। এ অবস্থায় ঘটনার রাত অর্থাৎ বুধবার দিবাগত রাতে ওই ভবনের ৩য় তলায় নিহত অঞ্জলী মালাকার ও তার কন্যা পূজা রায় এবং ২য় তলায় আমির আলী ছাড়া কেউ ছিলেন না।
রিপন আহমেদ নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ওই ভবনের নিকটবর্তী ক্ষেতে ২য় তলার বাসিন্দা আমির আলীকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে আমরা তাকে উদ্ধার করে বাহুবল হাসপাতালে পাঠাই। এর কিছুক্ষণ পর ৩য় তলার বাসিন্দা সঞ্জিত রায়ের কাছ থেকে জানতে পারি কে বা করা তার স্ত্রী-কন্যাকে গলা কেটে হত্যা করেছে।
জোড়া খুনের ঘটনার পরদিন শুক্রবার স্থানীয় দ্বিগাম্বর বাজার ও আশপাশের এলাকা ছিল শুনশান নিরব। লোকজনের আনাগুণা ছিল তুলনামূলক কম। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক অনেকেই। চা-দোকান বা অন্য আড্ডার মূল বিষয় জোড়া খুন। কিন্তু এ বিষয়ে মন্তব্য করতে সবাই একটু সাবধানী হলেও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে সবাই রয়েছেন সোচ্চার।
এদিকে, শুক্রবার বিকাল ৪টায় উপজেলার লামাপুটিজুরী শশ্মানঘাট এলাকায় নিহত মা-মেয়ের লাশের দাহ সম্পন্ন হয়েছে। দাহ অনুষ্ঠানে স্থানীয় পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
দাহ শেষে কথায় হয় স্ত্রী-কন্যা হারা শোকে কাতর সঞ্জিত রায়ের সাথে। তিনি বলেন, “আমি শতভাগ নিশ্চিত ২য় তলার বাসিন্দা আমির আলী-ই এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ঘটনার রাত ৪টা ৪৩ মিনিটে আমির আলী আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, তার ঘর চুরি হয়েছে, ঘরে থাকা সেলাই মেশিনসহ সব চোরেরা নিয়ে গেছে। চোরের ভয়ে সবাই তার বাসায় গেলেও আমার স্ত্রী যায়নি।” তিনি আরো বলেন, “দরজার পাশে আমির আলী ও তার সহযোগিদের আনাগুণা টের পেয়ে আমার স্ত্রী ওইরাত সাড়ে ৩টার দিকে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিল আমি যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসি। বাসায় তার ভয় লাগছে।” উত্তরে আমি বলেছিলাম, “এতদূর থেকে আমি কিভাবে আসব। এটায় তার সাথে আমার শেষ কথা।”
সঞ্জিত রায় বলেন, “আমি জানতে পেরেছি আটক আমির আলী পুলিশকে বলেছে সে ও তার সহযোগিরা কৌশলে আমার বাসায় প্রবেশ করে আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করার পর ছুরি দিয়ে আমার স্ত্রী ও সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, “সে ওইদিন রাতে আমার স্ত্রীকে ফোন করে তার পরিচয় দিয়ে তার বাসায় চুরি হয়েছে জানিয়ে দরজা খোলার জন্য অনুরোধ করে। আমার স্ত্রী এতে রাজী না হলেও বার বার সে ফোন করে ও ডেকে একই কথা বললে এক পর্যায়ে আমার স্ত্রী দরজা খুললে আমির আলী ও তার সহযোগিরা আমার ঘরে প্রবেশ করে।” তিনি বলেন, আমির আলীর বাম হাতের আঙ্গুলে একটি কামড়ের আঘাত রয়েছে। আমার স্ত্রী তার ইজ্জত রক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে এই কামড় দিয়েছিল বলে আমার ধারণা।
সঞ্জিত রায় আরো বলেন, আমি বৃহস্পতিবার ভোরে সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে মেঝেতে বিবস্ত্র অবস্থায় আমার স্ত্রীর নিথর দেহ দেখতে পেয়েছি। এ সময় আমার স্ত্রীর শরীরের বিভিন্ন স্থানে কামড় ও আছড়ের দাগ দেখেছি। এতে আমার ধারণা আমার স্ত্রীকে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভবনের ২য় তলার বাসিন্দা আমির আলী পুলিশের হেফাজতে আছে বলেই জেনেছি। জিজ্ঞাসাবাদে সে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও দিচ্ছে।