জালাল আহমেদ
ভূমিহীন কৃষকেরা কোথায় কোন চরে বাস করবে তা নির্ধারণ করে থাকে ভূমিদস্যুরা
১৯৬০ এর পর থেকে নোয়াখালীর চরে ভাঙ্গার চেয়ে গড়ার খেলাই বেশি ছিল। হাতিয়া উপজেলার উত্তরাংশ ভেংগে দক্ষিণে সরে যাচ্ছে কিন্তু নোয়াখালী মেইনল্যান্ডে এসে এখন হাতিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। এমন দিন দূরে নয় যে বর্তমান হাতিয়ার সমান ভূখন্ড নোয়াখালীর সংগে যুক্ত হয়ে যাবে। নোয়াখালীর চরের সেই জেগে ওঠা জমি নিয়ে প্রভাবশালীদের লড়াই ছিল চলমান। আবার সমস্বার্থে তাদের এক হয়ে কাজ করার নজিরও ছিল। চরের বেশিরভাগ জমি একসময় জোতদারদের পক্ষে লাঠিয়ালরা দখল করে নিতো। পরে বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমার কৌশলে জোতদারেরা চরের খাসজমি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতো। চরজব্বর, চরবাটা, চরবাগ্গ্যা, চর ভাটিরটেক (নোয়াখালী সদর), চর এলাহী (কোম্পানীগঞ্জ), চর আলেকজান্ডার (রামগতি) জুড়ে জোতদারদের লাঠিয়ালদের মধ্যে দখল বজায়ের যুদ্ধ লেগেই থাকতো। মাঝে মাঝে এই লাঠিয়ালদের যুদ্ধে অসংগঠিত ভূমিহীনরাও প্রতিপক্ষ হয়ে যেত। সেই সময় চরের উর্বর পলিযুক্ত জমি রক্তে লাল হয়ে পড়তো।
চরের জমির দখল বজায় রাখার জন্য নিজের শিশু সন্তানকে হত্যা করে প্রতিপক্ষের নামে মামলা করার নজির ও চর এলাকায় খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। চরের খাসজমি প্রান্তিক কৃষক ও ভূমিহীনদের মাঝে বন্দোবস্তের ফলে লাঠিয়ালদের মাধ্যমে চর দখলের মতো ফৌজদারি অপরাধ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। দেশের চরের জমি বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য সময় সময় পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর নোয়াখালীর চরাঞ্চলে ভারত থেকে আগত মুহাজিরদের বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছিল, যা আমি এর আগে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও লক্ষ্য করেছি। এই সেটেলমেন্টের জন্য সেই সময়ে নোয়াখালী জেলায় এডিসি (সেটেলমেন্ট) নামে একটি পদও সৃজন করা হয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে সেই মুহাজিররা নোয়াখালী জেলার মূল স্রোতধারার সাথে মিশে গেলেও একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য এখনো রয়ে গেছে।
পরবর্তীতে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদেরকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান করা হতো। স্বাধীনতার পর নদী থেকে জেগে ওঠা সব পয়স্তি জমি খাসজমি হিসেবে ঘোষণা করে এইসব খাসজমি নদীভাঙ্গা ভূমিহীন কৃষকদের নামে বন্দোবস্ত প্রদান শুরু হয় যা এখনও চলমান রয়েছে। এসময়েই একপর্যায়ে নেদারল্যান্ডস এর সহযোগিতায় এল আর পি বা ল্যান্ড রিক্লেমেশন প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়। আমরা সবাই জানি যে ল্যান্ড রিক্লেমেশনে ডাচ’রা দুনিয়া সেরা! স্থানীয় আটকপালিয়া বাজারে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উইন্ডমিল/হাওয়া কল বা পাংখা স্থাপন করে। বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব না হলেও বাজারের নাম হয়ে যায় পাংখার বাজার। এল আর পি’র অধীনে বেড়ীবাঁধ নির্মাণসহ ভূমিহীনদের মাঝে পরিবার পিছু আড়াই একর করে খাস জমি বিতরণ করে গুচ্ছগ্রাম সৃজন করা হয়। ভূমিহীনদের সংগঠিত করার জন্য কিছু এনজিওকে সম্পৃক্ত করা হয়।
সদর উপজেলায় ডাচ অর্থায়নে “ল্যান্ড রিক্লেমেশন প্রকল্পের” সমাপ্তির পর চর ব্যবস্থাপনার আরো উন্নয়ন ঘটানোর জন্য বিশেষত চরের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণসহ চরের মানুষের জীবিকায়নের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে “চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প” গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের কেন্দ্রে ছিলো ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তের মাধ্যমে তাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্পের আরেকটি মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত প্রদত্ত কৃষি খাসজমি সংরক্ষণের হার বা ল্যান্ড রিটেনশন ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি। প্রকল্পের মাধ্যমে নির্বাচিত ভূমিহীনদেরকে ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানের পর যাতে তারা পুনরায় ভূমিহীনে পরিণত না হয় সে লক্ষ্যে চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। আমি এই প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসাবে তিন বছর কাজ করি এবং এই পর্যায়ের সাফল্যের উপর ভিত্তি করেই সিডিএসপি প্রকল্পের একাধিক সংস্করণ গৃহীত হয়।
সিডিএসপি বা চর ডেভেলপমেন্ট এন্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্ট ছিল একটি মাল্টি-স্টেকহোল্ডার প্রকল্প। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয় মিলে এই প্রকল্প। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ছিল লীড মিনিস্ট্রি। তাদের দায়িত্ব ছিল পোল্ডার বা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা, স্থানীয় সরকার বিভাগ অবকাঠামো নির্মাণ করবে এবং ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বিতরণ করবে। সদর ও কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ১৬টি মৌজা জুড়ে ছিল এই প্রকল্প। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অংশের জন্য জেলা প্রশাসক প্রকল্প পরিচালক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করতো। সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ জাফর আলম ছিল প্রকল্পের সহকারী পরিচালক পদে।
প্রকল্পের একটি অফিস ছিল নোয়াখালীতে যেখানে একজন ওলন্দাজ দলনেতা ছিলেন, অৎবহফ াধহ জরবংংবহ আর দেশীয় বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন। আরডিসি একেএম জাকির হোসেন ভূঁইয়া’র শ্বশুর ইপিসিএস কর্মকর্তা আজিজুর রহমান ভূঁইয়া ছিলেন তাঁদের একজন। আব্দুস সোবহান আখন্দ নামে একজন অত্যন্ত দক্ষ পরামর্শকও এই দলে ছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি এই জেলায় অন্ততঃ ৩০০০ বর্গ কিলোমিটার ছিল চর এলাকা। নতুন চর এলাকার একটি বড় অংশ খাস জমি। অপেক্ষাকৃত পুরাতন চর এলাকার বন্দোবস্তকৃত খাস জমি’র মালিকেরা জমির দখল বিক্রি করে অন্যত্র খাস জমিতে বসবাস করছে। এটাও যে তাদের স্বইচ্ছায় তা নয়, ভূমি দস্যু বা জোতদার যে নামেই ডাকি না কেন বা যে চেহারায়ই তাদের দেখিনা কেন তারাই এসব ভূমিহীন কৃষকেরা কোথায় কোন চরে বসবাস করবে তা নির্ধারণ করে থাকে। সদর, রামগতি ও হাতিয়া উপজেলা’র তিনজন চেয়ারম্যান মূলতঃ অন্যদের সহযোগিতায় পুরো বিষয়টা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতো।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) স্টেট একুইজিশন এন্ড টেন্যান্সি এক্ট অনুযায়ী রাজস্ব আদালতও বটে। রাজস্ব আদালত হিসাবে এসি (ল্যান্ড) দের আদেশের আপীল শুনার একটা দায়িত্ব ছিল আবার এস এ এক্ট এর অধীনে মূল অধিক্ষেত্র অনুযায়ীও শুনানী করতে হতো, এর রায়ও দিতে হতো। আবার রায় লেখার সমস্যা শুরু হলো যেহেতু নথি বাসায় আনি না, আর অফিসে ব্যস্ততা ও ভিজিটরের চাপ। তখন শুরু করলাম সকালে একটু আগে করে অফিসে যাওয়া। এটা আমি অন্যত্রও করেছি। সকাল ৮টার মধ্যে অফিসে গেলে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একা সময় পাওয়া যেত। বিকেলে যথাসময়ে অফিস থেকে বের হয়ে যেতাম। তখন অফিস থেকে এসে গাড়ির চালককে ছুটি দিয়ে দিতাম। বিকাল পাঁচটার পর গাড়ি আমি নিজেই চালাতাম। আমার গাড়ি চালক জসিম এই ব্যবস্থায় খুশীই ছিল। যে কারণে তিন বছরে জুলাই ১৯৯৫ এর পর কোন মাসে আমার গাড়ির জ্বালানী ব্যবহার সীমা ছাড়ায় নাই।