জালাল আহমেদ
ঐতিহাসিক সেই দিনগুলো

ঐ সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌসুমের প্রভাব ছিল। বর্ষার শেষে রাজপথ গরম হওয়া শুরু হত আর তা চলতো শীতের শেষ পর্যন্ত। মাঝে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ এর দুটো নির্বাচনও গেল। ১৯৮৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) অংশ নেয়নি। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খালেদা জিয়া আপোষহীন নেত্রীর তকমা পেয়ে গেলেন। আওয়ামী লীগ সংসদে গিয়ে বুঝতে পারলো যে প্রত্যাশা নিয়ে তারা সংসদে এসেছিল তা পূরণ হবার নয়। অত্যন্ত স্মার্ট শাসক এরশাদ উভয় নেত্রীকেই সামলে নিয়ে তাঁর শাসনকালের সময় কাটাচ্ছিলেন। এরশাদ খুব ঠান্ডা মাথায় ক্ষমতা দখল করেন যখন তখনকার নির্বাচিত সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। এরশাদ সাহেব আসলে বিচারপতি সাত্তারের ব্যর্থতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার ৯ হাজার ব্যাঙ্ক কর্মচারীকে ছাঁটাই করে কঠোর হাতে ব্যাঙ্ক ধর্মঘট নিয়ন্ত্রণ করে ফেললে তাঁর উপর জনমনে আস্থা বেড়ে যায়। এরশাদ সাহেবের সুযোগও ফস্কে বেরিয়ে যাবার জোগাড়। তাই তিনি ২৪ মার্চ ১৯৮২ সামরিক শাসন দিয়ে দেশের প্রকৃত ক্ষমতার মালিক হয়ে যান।
১৯৮৩ এর ফেব্রুয়ারির ছাত্র বিক্ষোভ তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম প্রকৃত প্রতিবাদ। মিছিলের উপর ট্রাক তুলে দিয়ে, সেলিম-দেলোয়ারকে হত্যা করে সে পর্ব পার হয়। তারপর থেকে প্রতি বৎসরই আন্দোলন বাড়তে থাকে কিন্তু বড় দুই দলের আন্দোলন একসংগে না হওয়াতে আন্দোলনের যে ‘সিনার্জি’ তা ছিল না। একপর্যায়ে এসে যখন ১৯৮৮ এর সংসদ ও ‘গৃহপালিত বিরোধীদল’ জাসদ থাকা সত্ত্বেও হালে পানি পাচ্ছিল না তখন ৮ দল, ৭ দল এবং জামাতে ইসলামী যুগপৎ কর্মসূচী দিতে শুরু করে। ১৯৯০ সাল ছিল এই যুগপৎ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। নভেম্বর ১৯৯০ এ এসে সচিবালয়ের কর্মচারী এবং কর্মকর্তারাও আন্দোলনের সংগে গোপনে ও প্রকাশ্যে যুক্ত হতে শুরু করেন। এতে ট্রিগার হিসেবে কাজ করে ২৭ নভেম্বর ১৯৯০ ডাঃ মিলন এর মৃত্যু। টিএসসি’র পাশ দিয়ে রিক্সা করে যাবার সময় বিএমএ নেতা ডাঃ মিলন অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এই মৃত্যু আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তোলে। সচিবালয়ের ভেতরে কর্মকর্তা কর্মচারীরা দলবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের স্বপক্ষে সরকার বিরোধী ভূমিকা পালন করতে থাকে। নেপথ্যে চলে রাজনৈতিক কুশীলবদের যোগাযোগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ফরমুলা নির্ধারণ।
এরপর একদিন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা অফিস ছেড়ে রাজপথে নেমে আসেন। মিছিল করে আবু আলম, মিজানুর রহমান, ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, জাকিরুল ইসলামসহ আরো অনেকের সংগে সচিবালয় থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাবে যাই। যতদূর মনে পড়ে আমাদের পদত্যাগপত্রও সংগ্রহ করা হয়, প্রায় ২৫০/৩০০, আবু আলম ভাই বা মিজান ভাই কনফার্ম করতে পারবেন। এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। উপ রাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন, প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ উপ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখে পদত্যাগ করেন। তাঁর মন্ত্রিসভাও বিলুপ্ত হয়। উপরাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন এবং একটি উপদেষ্টামন্ডলী নিয়োগ দেন। সকল পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয় যে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে প্রধান বিচারপতি যেন স্বপদে ফিরে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হবে। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ছিলেন টিভি’র পর্দায় সবচেয়ে আনইম্প্রেসিভ লোকদের একজন। তিনি মূলতঃ ছিলেন সিএসপি, সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তানের একজন সদস্য। তখন সিভিল সার্ভিস থেকে বিচার বিভাগে কর্মকর্তা পদায়ন করা হত। এমন ১৮ জন কর্মকর্তাকে বিচার বিভাগে পদায়ন করা হয়। তাঁদের ১৬ জন সিভিল সার্ভিসে ফেরত আসলেও দুজন থেকে যান এবং তাঁদের মধ্যে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ প্রথমে বিচারপতি, আপীল বিভাগের বিচারপতি ও পরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে উন্নীত হন।
দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে যখন তাঁকে টিভি’র পর্দায় দেখানো শুরু হয় তা এক কৌতুককর আবহ সৃষ্টি করে। তাঁর প্রাচীন ছাটের পুরনো স্যুট, নাকের নীচে টুথব্রাশ মার্কা গোঁফ আর পা ফাঁক করে বসা এখনো মনে পড়ে। পরবর্তীতে আমি যখন ফরিদপুরে জেলা প্রশাসক তখন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের ব্যবহৃত পুরনো ডিজাইনের এক চেয়ারের সন্ধান পাই যাতে পা ফাঁক করে বসতে হত। তাঁর সেই অভ্যাস ঐ চেয়ার থেকে এসেছিল কি না কে জানে! চেয়ারটি ছিল এসডিও গোপালগঞ্জ এর এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ১৯৫৪ সালে গোপালগঞ্জ এর এসডিও ছিলেন। আমরা সবাই জানি ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে পরাজিত করে নৌকা মার্কা’র ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে এবং তখনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৩ বছর বয়সে প্রথম মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। সময়ের সংগে সংগে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সারাদেশে তার নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়। তাদের মূল কাজটি ছিল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যাতে জনগণ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
৬ ডিসেম্বর সরকার পতনের সংগে সংগেই আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে (বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়) যোগদান করি। ১৭ ডিসেম্বর আমাকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) নিয়োগ করা হয়। এই প্রথমবার কিন্তু শেষবার নয়, এর পরেও আমাকে একাধিকবার অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি নিয়োগ করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই আমার পরবর্তী পদায়নের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন জেএ-৪ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব ১৯৮১ ব্যাচের ইকরাম আহমেদ। আমিসহ আরো ৪ জনের নথি উপস্থাপন করা হল ঢাকায় মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পদায়নের জন্য। জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হবে, আমি ইকরাম আহমেদ এর রুমে বসা, তিনি নথি হাতে রুমে ঢুকলেন, বললেন তোমাদের ফাইল অনুমোদন হয়েছে, সামনের রুমে টাইপিস্টকে দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আদেশ টাইপ করাচ্ছেন। এ সময়ে একজন অত্যন্ত ক্ষমতাবান প্রশাসন ক্যাডারের নেতা প্রাক্তন সিএসপি সচিব ঢুকলেন সেই রুমে। কথায় কথায় জানতে চাইলেন কি আদেশ টাইপ হচ্ছে, মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট শুনে তিনি নথি হাতে নিলেন, নামগুলো দেখলেন এবং ফাইল হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলেন উপসচিব মাঠ প্রশাসন আবদুল কাইউম ঠাকুরের রুমে। ইকরাম ভাই অনুসরণ করলেন। একটু পরে ফাইল হাতে ফিরে আসলেন এবং বললেন যে, জালাল, তোমার নাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের তালিকা থেকে বাদ দিতে হচ্ছে!