জালাল আহমেদ
ভাগ্যিস তারা আমার স্যুটকেস খুলে নাই

জেলা বর্ষপূর্তি স্মরণিকা সম্পাদনার প্রাথমিক কাজ চলতে থাকে। বিষয়বস্তু নির্ধারণ, লেখক নির্বাচন, স্মরণিকার সাইজ ঠিক করা, বাজেট ও বিজ্ঞাপন সংগ্রহ তারমধ্যে অন্যতম। এরমাঝে নিয়মিত কোর্ট করার জন্য ১৫ দিন পর পর পানছড়ি যাওয়া। খাগড়াছড়িতে তখন কোন প্রেস নাই, স্মরণিকা ছাপাতে হলে চট্টগ্রামে দিতে হবে। তখন সদ্য পরিচিত মাটিরাংগা সিনেমা হল ও মাটিরাঙ্গা স’মিল এর মালিক ঝড়ষধরসধহ অষধস ঝবঃয এর সঙ্গে পরিচয়। তিনি বললেন যে চট্টগ্রামে তার নিজের প্রেস আছে, আইডিয়াল প্রেস, চকবাজার, সেখানে স্মরণিকা ছাপতে দিতে পারি। তাই হলো চট্টগ্রামে থেকে চকবাজার আইডিয়াল প্রেসে স্মরণিকা ছাপতে দিলাম, রাশ প্রিন্ট এরপর প্রুফ দেখলাম। মূল প্রিন্ট হলে তা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ফিরলাম। বিজ্ঞাপনের প্রুফ না দেখাতে যা হল ব্যাক কভারে বিসিকের বিজ্ঞাপনে “চামড়া শিল্প” হয়ে গেল “চাড়মা শিল্প”। ভুল করার এই ভুল আমি এখনো ভুলতে পারি না। শিক্ষা হলো এই, যে বিষয় অন্যদের গোচরে যাবে তা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিখুঁত করার চেষ্টা করা। কেউ কেউ আছেন একেবারে বাতিকগ্রস্ত, তা হওয়া যাবে না। কারণ টাইমলি ডেলিভারী’র একটা বিষয়ও আছে, এবং নিজের কাজে আত্মবিশ্বাসও থাকতে হবে। কিন্তু পুনর্বার দেখে নেওয়া দোষের কিছু নয়। তবে সোলায়মান আলমের সঙ্গে সেই যে পরিচয় তা দিনদিন আরো ঘনিষ্ঠ হয় এবং আজ পর্যন্ত সে সম্পর্ক বহাল আছে।
জেলা উদ্বোধনের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের পর আবার পানছড়ি ফিরে আসলাম। পানছড়ি কোর্ট বিল্ডিং এর কাজ তখনো শেষ হয়নি। সেই ছোট্ট টিনশেড ঘরেই কোর্টের কাজ চলছে। তবে গ্রীষ্মকাল বিদায় নেয়াতে গরমের কষ্টটা কমেছে। প্রথম যখন ওখানে কোর্ট করতাম তখন একজন দাঁড়িয়ে হাত পাখা নিয়ে বাতাস করতো। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন সেবা নেবার পক্ষপাতী ছিলাম না, ফলে গরমে কষ্ট পেতাম। কিছুদিন কাজ করার পরই মামলা কমতে শুরু করলো। কিছুদিন এর মধ্যে ২৪টা মামলা কমে ৫টিতে নেমে আসলো। আমার জেলা প্রশাসক বললেন তোমার ৫টা মামলা রাখার দরকার কি? শূন্য করে দাও। আমি বললাম স্যার, তাহলে আমার থাকার জাস্টিফিকেশন কি হবে। যদি বলেন শূন্য করলে আমকে তুলে নেবেন তাহলে করে দেই! পানছড়িতে এমনিতে কিছু করার নেই, কর্মকর্তার সংখ্যাও কম। তারমাঝেই ডাঃ পারেসুল, পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা নাজিমুদ্দিন, আর সহকারী কমিশনার নাজিম চৌধুরী মিলে একটু আড্ডা, ব্যাডমিন্টন খেলা, পরিষদের মাঠে ভলিবল খেলা দেখা বা কখনো উপজেলা সদরের উত্তরে সেনা ক্যাম্পে সেনা মেসের স্ন্যাক্স খেয়ে আড্ডা দেয়া। এভাবেই সময় কাটছিল।
ঐ সময়ে শান্তি বাহিনীর চাঁদাবাজি চরমে, কোন ঠিকাদার শান্তিবাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে কাজ করতে পারতো না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিকট থেকে একেবারে কেন্দ্রীয়ভাবে উপজেলা সদরে চাঁদা সংগ্রহ করা হতো। উপজেলার অফিসাররা প্রায় সবাই নিজ নিজ ভাবে চাঁদা দিয়ে দিতেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসের অফিস সুপার স্নেহময় চাকমা এগুলো সমন্বয় করতো। এ সময় একদিন চিঠি আসলো সহকারী কমিশনার (অর্থ) নাজিম উদ্দিন চৌধুরীর কাছে। আমি ভাবছিলাম যে তারপরতো আমি! পানছড়ির ৪ জন চেয়ারম্যানের মধ্যে পুজগাং এর চেয়ারম্যান অনুপম চাকমা এবং লোগাং এর চেয়ারম্যান জগদীশ চন্দ্র চাকমা উভয়ের শান্তিবাহিনী যোগাযোগ ছিল বেশি। জগদীশ ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। যে কোন কারণেই হোক জগদীশ এর সঙ্গে আমার একটা ভালো সম্পর্ক ছিল বলে আমি মনে করতাম। আমি জগদীশকে খবর দিলাম, আসলো পরে বললাম যে আমার কাছ থেকেও চাঁদা নিবেন নাকি? জগদীশ একদম জিভ কাটলো, বললো যে কেউ কিছু বলেছে কি না? আমি বললাম সহকারী কমিশনার যেহেতু চিঠি পেয়েছে তারপরতো আমি, কিন্তু আমিতো চাঁদা দিয়ে চাকুরী করবো না। আমি কারো কাছ থেকে এক পয়সা নেই না, বেতনের টাকা থেকে কাউকে দিবও না। জগদীশ বললো যে না, আপনার কাছে কেউ চাইবে না এবং শেষ পর্যন্ত আমার কাছে কেউ চাঁদা চায়ও নি। এরমাঝে ইউএনও সাহেব কাউকে বলেছিলেন যে শান্তিবাহিনীর কথা শুধু শুনেন, দেখেন তো না। একদিন খুব ভোর বেলা এসে আমাদের বাসায় দরজায় নক, ইউএনও সাহেব দরজা খুললেন, সামনের আংগিনায় জলপাই সবুজ ড্রেস পড়া ১০/১২ জন, বললো আপনি নাকি আমাদের দেখতে চেয়েছেন?
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চিঠি পাই বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ এর, শুরু হবে ১২ জানুয়ারী ১৯৮৫, বিপিএটিসি সাভারে। প্রস্তুতি নিতে থাকি ৪ মাস প্রশিক্ষণ এর। এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ একসময় ২২ সপ্তাহ ছিল, তখন টাইপিং ও ড্রাইভিংসহ ছিল প্রশিক্ষণ। আমাদের সময় টাইপিং ড্রাইভিং ছিল না বলে আমি চাকুরীতে যোগদানের আগে গাউসিয়া মার্কেটের কাছে এরোপ্লেন মসজিদ এর নীচে একটা কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট এ ভর্তি হয়ে টাইপিং শিখে নেই। আর ড্রাইভিং তখনো শিখি নাই। শিখেছি আরো পরে ঠেকায় পড়ে, তাও বলবো যথাস্থানে। পরে ক্র্যাশ প্রোগ্রামে এই ট্রেনিং এর মেয়াদ দাঁড়ায় কোন কোন ক্যাডারের জন্য দুই মাস। বিপিএটিসিতে এখন এই বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ এর মেয়াদ ড্রাইভিং ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সহ ৬ মাস। ৪ মাসের জন্য প্রশিক্ষণে যাবার প্রস্তুতি শুরু করি। আমাদের ৪ মাসের বেতন অগ্রিম তুলে নেবার অনুমতি দেয়া হয়েছিল ফলে আর্থিক অসুবিধা ছিল না। ৮ জানুয়ারী ১৯৮৫ পানছড়ি থেকে চট্টগ্রাম এসে রাতের ডলফিন এসি বাসে ঢাকা এলাম। ৯ তারিখ ভোরে বাস নামিয়ে দিল শাহবাগ মোড়ে, সঙ্গে তিন প্রস্থ লাগেজ। রিকশা নিলাম হাতিরপুলে মামার বাসায় যাবার জন্য। রিকশা যখন কাঁটাবন মোড়ের কাছে তখন চাদর গায়ে কয়েকটা ছেলে হাতে ইট নিয়ে আমার চোখের সামনে তিনটা বেবীটেক্সিকে আটকালো, আমি বুঝতে পারলাম যে কি হতে যাচ্ছে। দু’জন পেছনে এলো আমার রিক্সার কাছে, ছুরি ধরে বললো যা আছে দিয়ে দাও। উপরে রাখা আমার পুমা টেনিস ব্যাগের নীচের খোপে আমার টেনিস র‌্যাকেট, এক টানে হাতে নিতে পারবো। আমি একবার ভাবলাম যে প্রতিরোধ করি। পরে দেখলাম যে আমার সামনে বেবীটেক্সিগুলো থেকে কোন প্রতিরোধ হয়নি, আমি করতে গেলে সমস্ত চাপ আমার উপর চলে আসতে পারে আর পরদিন আমার ট্রেনিং শুরু এবং তারা আমার ব্যাগ বা স্যুটকেস খুলতে বলছে না। তখন আমি মানিব্যাগ খুললাম, ৪০০ টাকার কম ছিল, দিয়ে বললাম যে আমার রিকশা ভাড়া লাগবে, তখন আমাকে ১০ টাকা ফেরত দিল। একজন আমার বাঁ হাতে থাকা ঘড়িধরতে গেলো, আমি বললাম যে আমি খুলে দিচ্ছি। আমার এইচএসসি পরীক্ষার বৃত্তির টাকা থেকে ১৯৭৮ সালে ৬৪০ টাকা দামের ঘড়ি খুলে দিলাম। তখন তারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁটাবন মসজিদ, তখন টিন শেড, এর সামনে দিয়ে সূর্যসেন হলের দিকে চলে গেল। আমি হাতিরপুল হয়ে ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে মামার বাসায় চলে গেলাম। আমার জীবনের প্রথম ছিনতাই, ভাগ্যিস তারা আমার স্যুটকেস খুলে নাই!