জালাল আহমেদ
শ্লোগান না তুললে লাঞ্চ বন্ধ
‘খোকা’ মানে গুলির খোসা, ফায়ার করা গুলির খোসার হিসাব মিলছে না, খুঁজে বের করতে হবে। আমরা যে পজিশন থেকে ফায়ার করেছি আর যে জায়গাতে গুলির খোসা খুঁজছি তাতেই বুঝলাম যে কোন খোসা হারায়নি আর খুঁজে কোন খোসাও পাওয়া যাচ্ছিল না। তাও আমাদের দিয়ে অসম্ভব অসম্ভব জায়গায় খোঁজানো হচ্ছিল। এদিকে লাঞ্চ টাইম পার হয়ে গিয়েছে। ফিরতে আরো আধঘন্টা আর হাতে-পায়ে-গায়ে ধুলোবালিতে ভরপুর। একপর্যায়ে আমরা বিরক্ত হয়ে গেলে তারা আমাদের নিয়ে ফিরতি পথ ধরে। ফেরার পথে আমাদের শ্লোগান দিতে বা ছড়া পড়তে বলে! “উই আর ইন ডাবিøউ টি, স্কাই হাই মর‌্যাল ইন মি” জোরে জোরে বলতে হবে। দু’একবার বলার পর আমরা থেমে গেলাম। ট্রেনিং স্টাফরা আমাদের জোর করছে বলার জন্য, আমরা বলবো না। একপর্যায়ে তাদের কেউ বললো যে শ্লোগান না তুললে লাঞ্চ বন্ধ! আমরা বললাম যে, ওকে, আমরা লাঞ্চ করবো না। আমরা ডাইনিং এ না গিয়ে আমাদের আবাসন হলে চলে এসে লাইন ধরে বারান্দায় বসে গেলাম। বেলা যাচ্ছে আমরা তাও খেতে যাইনি, এরপর ক্লাশ আছে, তাও না। দুই সিনিয়র কর্মকর্তা, কর্ণেল আবু বাকার ও কর্ণেল আনোয়ারুল কবির তালুকদার আসলেন অন্য অফিসারদের নিয়ে। তাঁরা এসে আমাদের অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে লেট লাঞ্চে নিয়ে গেলেন তবে বিএমএ’র জন্য এটা ছিল প্রথম শক। তৃতীয় ব্যাচের শক ছিল আরো তীব্র, ঐ ব্যাচে আবু আলম ভাই সহ ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের অধিকাংশ কর্মকর্তা ছিলেন। যে কারণে পরবর্তী ব্যাচসমূহে এই প্রশিক্ষণ অধিকতর মানবিক হয়েছে। তখন তাঁদের বোধদয় হয় যে এটা কোন সামরিক প্রশিক্ষণ নয়, অবহিতকরণ মাত্র।
প্রশিক্ষণের শেষদিকে ছিল আমাদের মাইল টেস্ট। ছয় মিনিটে এক মাইল দৌঁড়ানো। এটা ছিল একটা রোড রান, আমরা দৌঁড়ালাম, আমাদের মধ্যে মাত্র একজন, Jnanendra Biswas ছয় মিনিটের ভেতরে এক মাইল দৌড় শেষ করতে পেরেছিল। আমি দ্বিতীয় হই অনেকখানি পেছনে থেকে, বাকিরা আরো পেছনে ছিল। এই মাইল টেস্টে দ্বিতীয় হওয়া আমার এখনো মনে পড়ে। শেষের আগে কমান্ডেন্ট এর গার্ডেন পার্টি, মেসের বাগানে, আমাদের পক্ষ থেকে একটা পেইন্টিং উপহার দেয়া হয়। অনেক আগেই চাকুরী ছেড়ে দেয়া আমাদের বন্ধু Sharif As-Saber তা হস্তান্তর করে। শরীফ অবশ্য এখন সেই হস্তান্তরের ফটোগ্রাফটা খুঁজে, পাচ্ছে না! ট্রেনিং শেষ করে আবার খাগড়াছড়িতে ফিরে আসা। ইতোমধ্যে আবার নতুন করে পাহাড়ে বাঙালি বসতি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে নিয়ে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন। সমালোচিত এই পদক্ষেপ শুরু হয় জেনারেল জিয়া’র আমলে। পরবর্তীকালে কেউ কেউ বসতি স্থাপনের সঙ্গে শান্তিবাহিনীকে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেছেন যা ঠিক নয়, শান্তিবাহিনীর জন্ম এ ধরণের বসতি স্থাপনের আগে।
শান্তিবাহিনী’র অশান্তি শুরু হয়েছে আগে থেকেই। আমি যখন খাগড়াছড়ি যাই তখন লক্ষিছড়ী সেটলার্স জোন দেখা হতো রামগড় থেকে। জোনাল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ১৯৭৯ ব্যাচের অফিসার জনাব আবু হায়দার সরদার, তিনি পরে রাঙ্গামাটি’র জেলা প্রশাসকও ছিলেন। মাটিরাঙ্গা জোনে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ১৯৭৯ ব্যাচের অফিসার ড. জাফর আহমেদ চৌধুরী। এরপর আসেন ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের Bazlul Haque Biswas। বজলুল হক বিশ্বাস পরে দীর্ঘদিন হজ্ব অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৪ সালে সিদ্ধান্ত হয় যে খাগড়াছড়ি জেলার অভ্যন্তরে নতুন করে সেটলার্স বসানো হবে। দীঘিনালা উপজেলার বাবুছড়াতে নতুন সেটলার্স জোন করা হয়। আমার ব্যাচমেট Anwarul Karim কে বাবুছড়াতে প্রেরণ করা হয় সেটলারস ভিলেজ স্থাপন, সেটলার্সদের সেটল করার জন্য। দীঘিনালা উপজেলা সদরের পর মাইনী সেতু পার হয়ে উত্তর দিকে যে রাস্তা গিয়েছে তাই বাবুছড়ার রাস্তা (জেড-১৬১০)। একজন শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা, যার বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ হয়নি তাঁকে এরকম আগুনে ফেলে দেয়া ছিল তাঁর জন্য এক বিরাট পরীক্ষা এবং তিনি এই পরীক্ষায় স্টার মার্কস নিয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
সেটলার্সদের চট্টগ্রামে পাহাড়তলি হাজি ক্যাম্পে এনে জড়ো করা হতো, সেখানে ছিল ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের আব্দুল হামিদ। সে তাদের দল বানিয়ে রিকুইজিশন্ড বাসে করে খাগড়াছড়ি পাঠাতো। এখান থেকে আমি চান্দের গাড়ি রেডি রাখতাম এবং বাস থেকে ট্রান্সফার করে চান্দের গাড়িতে তুলতাম। ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচের গউ এড়ষধস জধননধহর তাদের নিয়ে দীঘিনালা হয়ে বাবুছড়া নিয়ে যেতো। ওখানেই রাত কাটিয়ে পরদিন ফিরে আসতো। তারপরের দায়িত্ব আনোয়ারুল করিম এর। আমি আসলে তাঁদের তুলনায় সৌভাগ্যবান ছিলাম। মাঝে একদিন এক ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটলো। একজন তরুণ সেনা কর্মকর্তা কমলছড়ি ঘাটের ওখানে এক চান্দের গাড়ির স্টাফকে মারধর করে। ব্যাস, চান্দের গাড়ির শ্রমিকরা ‘বুনোবিড়াল’ (wild cat) ধর্মঘট মানে আকস্মিক ধর্মঘট ডেকে বসলো। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে গাড়ি ভর্তি সেটলার্স এসে বাবুছড়া যাবার জন্য বাজারের বাসস্ট্যান্ডে বসে আছে। খবর পেয়ে আমাকে পাঠানো হলো এই সমস্যা সমাধানে। শ্রমিকরাতো বিচার না হলে গাড়ি চালাবে না। আর সামরিক শাসনের যুগে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা কর্মকর্তার বিচারই বা কে করবে?