জালাল আহমেদ

রাস্তা ধরে হাঁটছি আর প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি এই বুঝি একটি বুলেট আমাকে বিদীর্ণ করলো

একদিনে এমন দুইবার দুই চাকা পাংচারের অভিজ্ঞতা আমার বাকি জীবনে আর হয় নাই, আর এমন অসময়ে, অনাকাক্সিক্ষত জায়গায়। আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার আলো, ওই আলোতে পত্রিকা পড়া যায়, হাতের রেখাও দেখা যায় এমন। আমার ভাবনায় তখন শান্তিবাহিনী, তারা যে আশেপাশের কোন হাইডআউট থেকে শতচক্ষুতে গাড়ি দেখছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমার প্রাণ, চালকের প্রাণতো যাবেই, সরকারী সম্পদ গাড়িটাও পুড়িয়ে দেবে। যে জায়গায় গাড়ি আটকালো তার ডানদিকে পাহাড়, বাম দিকে খাদ। একটু পর পাহাড়ের উপর থেকে কেউ চীৎকার করলো, “আপনারা কারা, গাড়ি থামিয়েছেন কেন?” আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনারা কারা?’ পরিচয় দিলো যে আনসার। তখন মনে পড়লো ঐ জায়গা থেকে ৩০০ মিটার সামনে একটা সেন্ট্রি পোস্টে সেনাসদস্য দেখেছি এবং পাহাড়ের উপর সড়ক বিভাগের পুরনো পরিদর্শন বাংলো (আইবি) রয়েছে। আমি পরিচয় দিলাম। বুঝলাম যে কথা বার্তা রিলে হচ্ছে। উপর থেকে বললো যে ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে ক্যাম্পে আসতে বলেছেন। আমি জানতে চাইলাম কে আছেন ওখানে, জানালো যে ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম। গাড়ির চালককে গাড়ির দিকে নজর রাখতে বলে আমি জীবনের দীর্ঘতম ৩০০ মিটার পথ হাঁটা শুরু করলাম। তখনো জানিনা যে এই হাঁটা ৩০০ মিটারে শেষ হবে না।
কবির কথা মনে পড়লো, যিনি লিখেছেন, ‘এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো, সে মরণ স্বরগ সমান!’ আমার কিন্তু ঐ ফকফকা জ্যোৎস্নায় একটুও মরতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু রাস্তা ধরে হাঁটছি আর প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি যে স্পষ্ট টার্গেটে পরিণত হয়েছি আমি। এই বুঝি একটি বুলেট আমাকে বিদীর্ণ করলো। বুকে বা মাথায় লাগলে তো সমস্যা নাই কিন্তু ওস্তাদের টিপ ভালো না হলেতো ‘দুইটা প্রশ্ন’ থাকবে। আমার মনে হচ্ছিল যে আমি ট্রাপিজের দড়ির ওপর হাঁটছি, রাস্তার পাশ বদলাচ্ছি হাঁটতে হাঁটতে। সেন্ট্রি পোস্ট পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৩০০ মিটার হাঁটা একসময় শেষ হলো কিন্তু এসে দেখি পোস্টে কোন সেন্ট্রি নেই। পরে জেনেছি যে পাহাড়ে কোথাও রাতে দূরের পোস্টে কোন সেন্ট্রি থাকে না। তারপর শুরু হলো আরো ২০০/২৫০ মিটার ভয়ঙ্কর কাঁচা রাস্তা ধরে পাহাড় বেয়ে ওঠা। ডানদিক থেকে ঝোপঝাড় রাস্তার উপর ঝুকে আছে। অন্ধকারে কে ওৎ পেতে আছে বোঝার কোন উপায় নেই। বুনো প্রাণীর ভয়ও পাচ্ছিলাম। ওখানে একটা তিনকোনা জলাশয় আছে, পরে আমাকে এই জলাশয়টির অবস্থান আর পানির উপস্থিতি অবাকও করেছে কিন্তু ঐ রাতে তা ভাবারও সুযোগ ছিল না।
জলাশয়ের পর রাস্তা খাড়া ৪৫ ডিগ্রী কোনে ঊঠে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের উপর বাংলোর সামনে গিয়ে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন রেজা সামনে বিস্কিট নিয়ে বসে আছেন, পাশেই খোলা চুলায় চা হচ্ছে। আমাকে দেখেই উঠে এগিয়ে এসে বললেন ‘ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, আজ রাতে আপনি এখানেই থাকবেন।’ আমি বললাম ‘থাকা যাবে, আগে গাড়ি উদ্ধারের ব্যবস্থা করুন’। খাগড়াছড়িতে খবর দেয়া হলো, ঘন্টাখানেক পর গাড়ির আওয়াজ পেলাম আর আধঘন্টা পর দুটো জীপ বাংলোতে এসে পৌঁছালো। এরমধ্যে চা বিস্কিট সহযোগে আড্ডা চলছিল। এরপর ডাল-রুটি দিয়ে ডিনার। এ ধরণের ক্যাম্পগুলোতে সাধারণতঃ একজন নিঃসঙ্গতায় ভোগা অফিসার থাকে এবং তাঁরা অতিথিপরায়ণ হয়। পরবর্তীতে আমি এমন অনেক ক্যাম্পেই রাত কাটিয়েছি। গাড়ি ঠিক হওয়ায় রাত্রিযাপন না করে আমি খাগড়াছড়ি ফিরে আসি।
ফিরে দেখি সব অফিসাররা ডিসি সাহেবের বাসায় অপেক্ষমান। এসডিও সাহেব এরমধ্যে আমার নিরাপত্তার জন্য দু’রাকাত নফল নামাজও পড়ে ফেলেছেন। তাঁদের সবার ভালোবাসায় আপ্লুত হলাম। আমার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনে সবাই একে একে ফিরে গেলো। ১০ তারিখ রাতে আমি যখন আলুটিলায় আটকে আছি তখন স্বাভাবিকভাবেই কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু ঘটছেই। তেমনি আরেক জায়গায় তখন ঘটেছিল এক বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা। আগের পর্বে শান্তি বাহিনীর ‘লাম্বা’ ও ‘বাদি’, ‘লং এন্ড শর্ট’ উপদল সৃষ্টির কথা বলেছিলাম। দুই উপদলের মাঝে সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়েই বিভাজন চলছিল। স্বাভাবিকভাবেই উভয় উপদল ছিল সশস্ত্র এবং বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র সংঘর্ষও হতে থাকে। শান্তিবাহিনীর প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের ২০ জন অফিসার রিক্রূট দুই উপদলের মাঝেই প্রভাবশালী ভূমিকায় ছিল। ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন শান্তিবাহিনীর লাম্বা-বাদি দুই গ্রুপের সংঘর্ষে প্রীতি গ্রুপের গেরিলা কমান্ডার অমৃতলাল চাকমা ওরফে বলি ওস্তাদসহ অনেকে নিহত হয়। শান্তিবাহিনীর প্রধান দু’জন প্রশিক্ষক এর একজন ছিলেন বলি ওস্তাদ, প্রথম প্রশিক্ষক নলিনী রঞ্জন চাকমা ওরফে বুড়া ওস্তাদ পরে আত্মসমর্পণ করেন। প্রীতি গ্রুপ বলি ওস্তাদের মৃত্যুর প্রতিশোধের শপথ নেয়। এরমাঝে ঐক্যের আলোচনাও শুরু হয়। ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ দুই গ্রুপের যৌথ সভার তারিখ ঠিক হয়। ১০ তারিখে রাতের বৈঠকে প্রীতি গ্রুপ বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং সশস্ত্র হামলা করে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, তাঁর বড় ভাই প্রভাস লারমা ওরফে বুলুসহ অনেককে হত্যা করে। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা উপস্থিত থাকলেও হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যান।
এ ঘটনা যেমন আমরা ১০ তারিখে জানতাম না, তারপরের দু’দিনও জানাজানি হয় নাই। ১৩ নভেম্বর ১৯৮৩ আমরা জানতে পারি যে পানছড়ি উপজেলার পুজগাং সীমান্তবর্তী ভগবানটিলায় প্রীতি গ্রুপের হাতে এমএন লারমা নিহত হয়েছেন। গোলাম মোরতোজা’র বই “শান্তিবাহিনীঃ গেরিলা জীবন” এ জনসংহতি সমিতির বরাত দিয়ে বলা হয় যে খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তবর্তী দুদুকছড়ি এলাকায় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় যা পূর্বোল্লিখিত ভগবানটিলাকে সমর্থন করে। জ্ঞ্যানেন্দুবিকাশ চাকমা তাঁর বইতে ঘটনাস্থল ভারতের ত্রিপুরা বলে উল্লেখ করেছেন। মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বিপি তাঁর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’ বইতে উল্লেখ করেন “১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাসহ শান্তিবাহিনীর ৮ জন সদস্য ভারতের ইজারা গ্রামের বাঘমারা শান্তিবাহিনী ক্যাম্পে প্রতিপক্ষ প্রীতি গ্রুপের হামলায় নিহত হন। এ ঘটনার পর শান্তিবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।” আমি পানছড়িতেও চাকুরী করেছি। স্থানীয় তথ্য হলো ভগবানটিলা, বাংলাদেশ সীমানায় কিন্তু বাংলাদেশ থেকে দুর্লঙ্ঘ্য, অগম্য। তার তিনদিকে ভারতের ত্রিপুরা এবং ত্রিপুরা থেকে সহজে আরোহনযোগ্য ফলে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে ভারতের সীমানাঘেরা বাংলাদেশের মাটিতে। বিপ্লবী মানবেন্দ্র লারমা’র গোপন জীবন তাঁর এক সময়ের সহযোদ্ধাদের হাতেই শেষ হয় আর পাহাড়ীদের অবিসংবাদিত এই নেতার মৃত্যুর পর আর কেউ এমন একচ্ছত্র নেতৃত্বের আসনে বসতে পারেননি।