ঢাকের তালে চলে রং আর সিঁদুর খেলা
স্টাফ রিপোর্টার ॥ দশমী বিহিত পূজা, দর্পণ বিসর্জন, দেবীকে মিষ্টিমুখ করানো, ভাল থাকার আশীষ চাওয়া, রং আর সিঁদুর খেলা শেষে বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটল পাঁচদিনব্যাপী শারদীয় দুর্গাপূজার। শেষ দিনে হাসি আনন্দের সঙ্গে ভক্তদের চোখে ছিল জল। বিদায় বেলা অনেকে অঝোরে কেঁদেছেন। সন্ধ্যার পর চলে বিসর্জন পর্ব।
ভক্তরা বলছেন, মহামারীর কারণে শোভাযাত্রার কোন সমারোহ এবার ছিল না। তারপরও তো বিজয়া দশমী; ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবীর দেবালয়ে ফেরার দিন। ঢাকের বাদ্য আর অশ্রুভেজা ভালবাসায় তাকে বিদায় জানিয়েছেন মর্ত্যরে বাসিন্দারা। উৎসবকে পরিপূর্ণ করতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়ি বাড়ি যাত্রা পেতেছেন। মিষ্টির দোকানগুলোতে এবার কমবেশি লাড্ডু কেনার ধুম চোখে পড়ে। সেইসঙ্গে একটু ভালমন্দ খাওয়ার আয়োজন ছিল কমবেশি সব পরিবারেই।
ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় ‘আনন্দময়ীর’ নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল, সোমবার দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনে তার সাঙ্গ হলো। বাবার বাড়ি বেড়ানো শেষে দেবী দুর্গা এক বছরের জন্য ফিরে গেলেন ‘কৈলাসের শ্বশুরালয়ে’; সমাপ্তি হলো বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় পার্বণ শারদীয় দুর্গোৎসবের।
পঞ্জিকার হিসাবে এবার আশ্বিন মাস ‘মল মাস’, মানে অশুভ মাস। সে কারণে ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়া হলেও দেবীর পূজা এবার হয়েছে কার্তিক মাসে। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে বৃহস্পতিবার বিকেলে দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পেরিয়ে সোমবার সকালে বিজয়া দশমীর ‘বিহিত পূজায়’ ষোড়শ প্রচার পূজার পাশাপাশি দেবী প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। সবশেষে দর্পণ বিসর্জনের সময় প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে তাতে দেবীকে দেখে তার কাছ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বিদায় নেন ভক্তরা।
মহামারীর মধ্যে কড়াকড়ি থাকলেও অন্যবছরের মতো এবারও প্রতিমা বিসর্জনের আগে কোন কোন মন্ডপে আবির খেলায় মেতে উঠেছেন ভক্তরা। বিভিন্ন মন্ডপে হিন্দু নারীরা একে অন্যকে সিঁদুর পরিয়ে দিতে দেখা গেছে। ভক্তরা বলছেন, একে অন্যের মঙ্গল কামনায় তারা সিঁদুর পরান। যেন আগামী বছর একই বেশে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আবারও উৎসবে যোগ দিতে পারেন।
বিবাহিত নারীরা সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গাকে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর একে-অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে দেন। তারা এই সিঁদুর মাখিয়ে দুর্গা মাকে বিদায় জানান। দুর্গাকে নিয়ে যাওয়ার আগে সিঁথিতে সিঁদুর মাখানোর পর আঙ্গুলে লেগে থাকা বাকি সিঁদুরটুকু তারা একে-অপরের মুখে মাখেন। এটিকে অনেকে সিঁদুর খেলাও বলে থাকেন।
মুখ রঙিন করে হাসি মুখে মাকে বিদায় জানানোর জন্যই এই সিঁদুর খেলা। তাই মাকে বিসর্জনের আগ পর্যন্ত তারা একে অপরকে সিঁদুর লাগিয়ে মিষ্টিমুখ করেন, নাচ, গান করেন, যেন সারাটা বছর এমন আনন্দেই কাটে। রাতে বিসর্জন শেষে মন্দিরে শান্তির জল নিয়ে আসা হয়; মন্ডপে করা হয় আশীর্বাদ।
এবার সপ্তমী শুক্রবার হওয়ায় হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দুর্গা এবার এসেছিলেন দোলায় চেপে। আর সোমবার দশমীতে দেবালয়ে ফিরলেন হাতির পিঠে চড়ে। দোলায় আগমন নিয়ে শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘দোলায় মরকং ভবেৎ’; অর্থাৎ মহামারী, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, মন্বন্তর, খরার প্রভাবে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুতো ঘটাবেই, আবার সেই সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতিও হবে।
আর হাতিতে চড়ে দেবী বিদায়ের ফল হয়- ‘গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ তাতে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং শস্য ফলন ভাল হয়। সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ হয় মর্ত্যভূমি। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, এক বছর পর নতুন শরতে আবার দেবী আসবেন ‘পিতৃগৃহ’ এই ধরণীতে।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সর্বশেষ দেয়া তথ্য অনুসারে, এ বছর সারাদেশে ৩০ হাজার ২শ’ ২৩টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।