জালাল আহমেদ
চাকুরীর শুরুতে একজন দক্ষ কর্মনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম

২০২০ সালের যেদিন এই লিখা লিখছি তার কিছুদিন আগে ২৩ জুলাই মারা গেলেন জনাব নুরুন্নবী চৌধুরী, তৎকালীন খাগড়াছড়ি শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক এবং মহকুমা ও পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। এই খবর আমাকে জানিয়েছিলেন তখনকার তরুণ সাংবাদিক, ইত্তেফাকের মহকুমা প্রতিনিধি Tarun Bhattacharjee। নুরুন্নবী চৌধুরী, দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী এবং বাদশা মিয়া সওদাগর এই তিনজন ছিলেন বাঙালি সমাজের মুরুব্বী। আমার খাগড়াছড়ি অবস্থানকালীন অনেক বিষয়েই তাঁদের সংগে মতবিনিময় করেছি, সহযোগিতা পেয়েছি। তখনকার ৩৪টি বাজারের প্রত্যেকটিতে বাজার ফান্ড থেকে নিয়োজিত একজন বাজার চৌধুরী ছিলেন, বাজারের তোলা আদায় ও দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনার জন্য। খাগড়াছড়ি বাজারের চৌধুরী ছিলেন চাইলাপ্রু চৌধুরী। বাজারের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরনো বাসিন্দাদের একজন বাদশাহ মিয়া সওদাগর, তার ভ্রাতুষ্পুত্র জাহেদুল আলম খাগড়াছড়ি পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান। জাহেদুল আলম তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র আর আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর। এই বিষয়টি একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। আমি তাদের সঙ্গে বাজারের মাঠে ফুটবল ও খেলেছি। তখন জানতাম না কিন্তু এখন জানি যে বিখ্যাত সিএসপি ডঃ আব্দুস সাত্তার যখন মৌলভীবাজার এর মহকুমা প্রশাসক তখন মাঠে ফুটবল খেলতেন। একথা লিখেছেন শেষ ব্যাচের সিএসপি আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী উনার আত্মজীবনী “কালের নিরন্তর যাত্রা” তে। পরবর্তীতে ঠাকুরগাঁও এর জেলা প্রশাসক হিসেবে জেনেছি যে ঠাকুরগাঁও এর এক সময়ের এসডিও সিএসপি আজিজুল হকও বড় মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। এই মেলামেশার ফলে স্থানীয় চাকমা, ত্রিপুরা ও মং ছেলেদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে যা আমার তিন বৎসর খাগড়াছড়ি অবস্থানকালে খুবই সহায়ক ভুমিকা রেখেছে।
ওই সময়েই ব্রিগেড কমান্ডার খাগড়াছড়িকে জেলা করার জন্য আগ্রহ দেখাতে থাকেন কারন তাকে যদি কথা বলতে হয়, তাহলে তা’ মহকুমা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে। পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের বিষয়েও সরকারের আগ্রহ ছিল। অক্টোবর মাসেই আমরা জেনে গেলাম যে খাগড়াছড়ি দেশের ২২ তম জেলা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে জানা গেল যে জেলা উদ্বোধন হবে ৭ নভেম্বর ১৯৮৩ এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেঃজেঃ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নিজেই উদ্বোধন করতে আসবেন। সাজ সাজ রব পরে গেলো বেসামরিক-সামরিক উভয় কর্মকর্তাদের মাঝে। এর সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য অনুষ্ঠানের কথাও চিন্তা করা হচ্ছিল। খাগড়াছড়ি শহরে বাচ্চাদের কোন ভালো স্কুল ছিল না। মূলতঃ ৩৬ ইস্টবেংগল এর সিও লেঃ কর্ণেল আরেফুর রহমান এর উদ্যোগে ও আমদের সহযোগিতায় এসডিও অফিসের পাশেই, আমাদের বাসার লেভেলের নীচের পাহাড়ে নতুন কুঁড়ি কিশলয় নামে একটি শিশু বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এ সুযোগে এই স্কুলটি উদ্বোধনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে সামরিক কায়দায় একটি টিনশেড পাকা স্কুল ঘর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেল। খাগড়াছড়িতে সরাসরি টেলিযোগাযোগ সুবিধা ছিল না। সরাসরি ডায়ালিংও এ সময়ে উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া অফিসারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ও দুপুরের পর স্কুল মাঠে জনসভার সিদ্ধান্ত হয়। বিকেলে সংগীতানুষ্ঠান।
ইতোমধ্যে আমি ক্লাবের কার্যক্রমে কিছুটা যুক্ত হতে শুরু করেছি। ক্লাবে টেবিল টেনিস খেলতাম, কার্ড খেলতে পারতাম না যদিও। আমাকে সভাপতি করে একটা কমিটি করা হল ক্লাব স্থানান্তর এর জন্য নতুন স্থান নির্ধারণের। খাগড়াছড়িতে তখন কোন টেনিস কোর্ট ছিল না, সেনা কর্মকর্তাদের জন্যও না। খাগড়াছড়ি সরকারী স্কুলে মাঝখানে একটি আয়তাকার মাঠ রেখে চারিদিকে ভবন ছিল। চারিদিকে ভবনের সুবিধা পেয়ে মাঝখানের মাঠে আমরা টেনিস কোর্ট বানিয়ে ফেলি এবং সেখানে টেনিস খেলা শুরু করি। বিএম মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন কামাল মুজতাবা আলী (পরে দেখা গেল যে তিনি প্রথম জেলা প্রশাসক এর শ্যালক), ক্যাপ্টেন আতিক সহ আরো কোন কোন সেনা কর্মকর্তা খেলতে আসতেন। খেলার মাঠেই পরিচয় হয় মিতু’র সংগে, মিতু তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, তার বাবা নবীনকুমার ত্রিপুরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ভাই কুবলেশ্বর ত্রিপুরা সিভিল সার্ভিসে আমার ব্যাচমেট যদিও তখন তা জানা ছিল না। পরে পরিচয় হয় তার বড় বোন রীতা’র সংগেও।
এদিকে মাস শেষ হয়ে আসতে থাকে আর এগিয়ে আসতে থাকে জেলা উদ্বোধনের তারিখ। প্রথম জেলা প্রশাসকের পোস্টিং হয়। তিনি আসার আগেই এসডিও সাহেব আমাকে ডেকে বলেন যে আমাকে বাসা বদল করতে হবে, থাকতে হবে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে, এসডিও’র বাংলোতে। আমিতো আকাশ থেকে পড়লাম, বললাম যে উনি ৬২’র ব্যাচ আর আমি ৮২’র ব্যাচ, এক সঙ্গে কেমনে থাকি। উনি বললেন যে জেলা প্রশাসক সাহেব এটা বলেছেন কারণ তিনি পরিবার আনবেন না। জেলা প্রশাসক উনার পরিচিত, ভদ্র ভালো মানুষ, ৬১ সালে উনারা ফেনী কলেজে একসঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। এসডিও সাহেব ইতোমধ্যে এডিশনাল এসডিও’র বাংলোতে শিফট করে নেন। জেলা প্রশাসক জনাব মাইজুদ্দিন আহমেদ সাহেব আসলে আমি উনার সঙ্গে থাকার জন্য জেলা প্রশাসক বাংলোতে শিফট করি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসাবে পোস্টিং হয় জনাব এ এম এম রেজা ই রাব্বী, ইপিসিএস ১৯৭০ সালের ব্যাচ। আরো দুজন ম্যাজিস্ট্রেট যোগদান করেন ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচ এর, রুহুল আমিন ও ফজলুল করিম, রুহুল আমিন এর সংগে আমার এখনো যোগাযোগ আছে। তাঁরা এসে তোপের মুখে পড়েন কিন্তু আমি একটু হালকা হই। তবে তাঁরা দুজনেই আমার চেয়ে কমপক্ষে ১০ বছরের বড় এবং আগে বিভিন্ন চাকুরীর অভিজ্ঞতা পুষ্ট, আমার মত রংরুট না। তাঁরা আমার পুরনো আস্তানায় উঠে পড়েন। এর মাঝে ১২ অক্টোবর আমি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষমতা প্রাপ্ত হই। আর আবাস হিসেবে জেলা প্রশাসক বাংলোতে বড় এক কক্ষ পেয়ে যাই। পরে দেখা যায় যে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এই একসংগে থাকায় আমার জীবন কিছুটা সীমাবদ্ধ হলেও উপকারই হয়েছে। চাকুরীর শুরুতে একজন দক্ষ, কর্মনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সান্নিধ্য আমি লাভ করেছিলাম।