জালাল আহমেদ
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের “আর্মি ডিসপোজাল” জীপ দিয়েই পার্বত্য অঞ্চলে শুরু হয়েছে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের যাত্রা
আমি নিজে ৪৭ জনের একজন হয়ে চান্দের গাড়িতে উঠেছি। চালকের পক্ষে সামনে রাস্তা দেখা সবসময় সম্ভব হতো না, সহকারী পেছন থেকে চিৎকার করে গাইড করতো। ডানে মোড়, বায়ে মোড়, সামনে ঢেউ, বড় ঢেউ, ছোট ঢেউ…

থেমে যাওয়া বাস থেকে নেমে একটু হেঁটে গিয়ে মাটিরাঙ্গা’র ইউএনও সাহেবের অফিস রুমে ঢুকে পরিচয় দিতেই তাঁর প্রথম প্রশ্ন লাঞ্চ করেছি কোথায়? দুপুরে রামগড়ে চা বিস্কিট খেয়েছি বলার সাথে সাথেই তিনি আমাকে নিয়ে অফিসের পেছনে তাঁর বাসায় চলে আসলেন। সঙ্গে আরেকজন ছিলেন, যিনি উনার ব্যাচমেট ছিলেন, জালিয়াপাড়াতে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ কাজ দেখতে এসেছিলেন। আমরা রামগড় থেকে একই বাসে করে এসেছি। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে খেতে বসলাম, সামনেই মূল রাস্তা। আচমকা চোখে পড়লো পর পর তিনটি চান্দের গাড়ি চলে গেলো। ইউএনও সাহেব বললেন, এই গাড়িগুলো খাগড়াছড়ি যাবে। আমি বললাম স্যার, তাহলে আমিও চলে যাই। একজন পিয়ন পাঠিয়ে দেয়া হলো গাড়িকে অপেক্ষায় রাখতে। ইউএনও সাহেব নিজে সঙ্গে এসে অপেক্ষমান একটি জীপে আমাকে তুলে দিয়ে গেলেন বাকি দু’টো না থেমে চলে গিয়েছিল। এই গাড়িগুলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বেঁচে যাওয়া উইলি জীপ গাড়ি, কেউ কেউ সলিম মিয়ার গাড়িও বলতো কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এই অঞ্চলে কমান্ডার ছিলেন ফিল্ডমার্শাল উইলিয়াম যোসেফ স্লিম, ফার্স্ট ভাইকাউন্ট, কেজি, জিসিবি, জিসিএমজি, জিসিভিও, জিবিই, ডিএসও, এমসি, কেএসজে ওবিই (তাঁর ডেকোরেশনগুলা শুধু দেখেন!!)। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এই “আর্মি ডিসপোজাল” জীপ দিয়েই পার্বত্য অঞ্চলে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের যাত্রা শুরু।
আমার জীপ আর ছাড়ে না, তার সীট ক্যাপাসিটি পূরণ হয় নাই। জিজ্ঞেস করলাম সীট ক্যাপাসিটি কত? বললো ২০, এখন কতজন আছে, বললো ১৭, আমি বললাম ছাড়ো, বাকী তিনজনের ভাড়া আমি দিব। যাত্রা শুরু হলো।
মাটিরাঙ্গার পর ৮ কিলোমিটার রাস্তা সমতল এরপর রাস্তা পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলো আলুটিলার দিকে। জীপের বনেটে ৮ জন, জীপ যেনো পেছনে উল্টে না যায়। ড্রাইভারের একপাশে একজন, আরেক পাশে ৩ জন, তখন আমি একা, পেছনে ৮ জন, একুনে এই ২০ জন হলো সীট ক্যাপাসিটি। কিন্তু এতে ৩০ থেকে ৫০ জন হরদমই উঠতো, আমি নিজে ৪৭ জনের একজন হয়ে এই চান্দের গাড়িতে উঠেছি। চালকের পক্ষে সামনে রাস্তা দেখা সবসময় সম্ভব হতো না, সহকারী পেছন থেকে চীৎকার করে গাইড করতো। ডানে মোড়, বায়ে মোড়, সামনে ঢেউ, বড় ঢেউ, ছোট ঢেউ, মানে রাস্তা উঁচুনিচু। পাহাড়ে উঠতেই ঝামেলা শুরু হলো। কোথাও কোথাও রাস্তার কার্পেটিং উঠে গেছে, কোথাও রাস্তার উপর কাঁদামাটির স্তুপ। এক পর্যায়ে গাড়ি আটকে গেলো। সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলো ধাক্কানোর জন্য। আমাকে নামতে দেয়া হলো না। কিন্তু গাড়ি আর চলে না। তারপর আমিও জুতো বদলে, ঐ সময়ে নতুন বের হওয়া বাটার ছন্দক পায়ে দিয়ে নেমে গেলাম। আমাকে গাড়িতে হাত দিতে দিলোনা তাই হেঁটে হেঁটে উপরে উঠতে লাগলাম। অনেকখানি উঠে যাবার পরও গাড়ি আসে না। বসলাম এক জায়গায়। এদিকে বিদায়ী গ্রীষ্মের লম্বা দিন পার হয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। ভয় ভয় লাগছে কারণ এখানে কি কি বুনো প্রাণী আছে জানি না, ভল্লুক আর চিতাতো আছেই, পরে জেনেছিলাম ছিল পাগলা হাতি। আবার নামতে শুরু করে দেখি যে জীপ তখনো আটকে আছে। আমিও হাত লাগালাম। যে নো আমার অপেক্ষায়ই ছিল, মাটির কামড় ছাড়িয়ে জীপ চলতে শুরু করলো।
আরো কিছুদূরে যাবার পর কাঁচা রাস্তা, আলুটিলা’র কাছে রাস্তা খুবই খারাপ আর তখন অন্ধকারও হয়ে আসছে। কোথাও কোথাও গাড়ি কাত হয়ে যাচ্ছে আর টিপ টিপ বৃষ্টিতে পাশে হাঁটা যাত্রীরা হাত দিয়ে ধরে গাড়িকে উল্টে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে। এখন যারা সাজেক যেতে খাগড়াছড়ি যান তাঁরা ১৯৮৩ এর সেই রাস্তা কল্পনাও করতে পারবেন না। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে আর টিপটিপ বৃষ্টিও হচ্ছে, গাড়িরও নামতি যাত্রা শুরু হলো, তখন একটু সহজ হলো গাড়ি চালানো। সব যাত্রারই শেষ আছে, এই যাত্রাও শেষ হলো চেংগী নদীর পারে। আমিতো বুঝিনি কিছু, মুহূর্তের মধ্যে সব যাত্রী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। চেংগী নদীতে তখনো সেতু হয়নি, যেখানে গাড়ি থামলো তাঁর সামনে ফেরী ঘাট, এটি গোলাবাড়ি ঘাট, বর্তমান সেতু থেকে অনেক দক্ষিণে, ভাটিতে, জুরিন্দা ফেরী কিন্তু সন্ধ্যার পর চালানো হয় না। যাত্রীরা যে যার নিজের মতো নদী পার হয়ে নাই হয়ে গেলো, আমি ড্রাইভারকে বললাম যে আমাকেতো রেস্টহাউজে পৌঁছে দিতে হবে, তাঁরা রাজী হয়ে গেলো। তখন খেয়াল করলাম যে গাড়ির উপরে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, এটা ছিল এলপি গ্যাসচালিত গাড়ি। ড্রাইভার গ্যাস বিচ্ছিন্ন করে আরো দু’একটা তার খুলে হেল্পারসহ আমার মালপত্র নিয়ে সড়ক থেকে নামতে শুরু করলো, আমি অনুসরণকারী!
প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে খাগড়াছড়ি বাজারের পেছনে পৌঁছালাম, ডাকাডাকি করে একটা নৌকা আনা গেলো, নৌকায় নদী পার হয়ে বাজারের পেছন দিয়ে কাঁদাপানি ভেঙ্গে আরেকটু হেঁটে বাজারে উঠলাম। বাজার চৌরাস্তায় যাবার পর একটু আলো, প্যান্ট গুটানো, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা, সঙ্গী দুইজনের হাতে মাথায় হোল্ডঅল, স্যুটকেস, ব্যাগ, কি দৃশ্য ছিল তা আমি এখন ভাবি। জিজ্ঞেস করে করে দুই কিলোমিটারেরও বেশি হেঁটে দুই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এরপর রেস্টহাউস পাওয়া গেল, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের রেস্টহাউস। অনুসন্ধানে জানা গেলো যে রুম একটা খালি আছে, আমার ভাগ্য, কারণ পরে খাগড়াছড়িতে চাকুরীর সুবাদে জানতাম যে এই রেস্টহাউজে রুম পাওয়া আসলেই ভাগ্য! এসডিও সাহেবকে ফোন করলাম, উনার তো হার্ট অ্যাটাক হবার উপক্রম যে রাত ন’টার সময় আমি কোথা থেকে কি করে খাগড়াছড়িতে এসে পৌঁছালাম!