জালাল আহমেদ
“নিজেদের বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে সুবিচার ও ন্যায় পরায়ণতা হতে বিরত থেকো না” প্রশিক্ষকের এই উপদেশ আমি জীবনে অনুসরণের চেষ্টা করেছি
সিভিল অফিসার ট্রেনিং একাডেমী (কোটা) তে আহূত ১৫০ জনের মধ্যে আমরা ১৩৫ জন যোগদান করি। মেধা তালিকায় আমার অবস্থান ১৬ হলেও যোগদানপত্র অনুযায়ী দেয়া নিয়োগপত্রে আমার ক্রমিক ছিল ১২। আমি ছিলাম যোগদানকৃতদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট, যোগদানের তারিখে আমার বয়স ছিল ২২ বছর ৫ মাস ১৫ দিন। বাংলাদেশ প্রজন্মের প্রশাসন ক্যাডারের কোন কর্মকর্তা হয়তো আমার চেয়ে কম বয়সে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেননি। কিছুদিনের মধ্যেই প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষক সবাই আমাদের পিতা-পুত্রের একসাথে প্রশিক্ষণে যোগদানের বিষয়টি জেনে যায়। ঐ সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা “দৈনিক ইত্তেফাকে” এ বিষয়ে একটি সংবাদও প্রকাশিত হয়।
আমাদের প্রশিক্ষণকালে কোটা’য় প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রাক্তন সিএসপি ড. ফজলুল হাসান ইউসুফ। পরিচালক ছিলেন প্রাক্তন সিএসপি ড. সা’দত হুসাইন, প্রাক্তন ইপিসিএস জনাব এএমএম বাহাদুর মুন্সী, কাজী সিরাজুল হোসেন এবং জগন্নাথ দে। অতিরিক্ত পরিচালক ছিলেন মিজ নীলুফার বেগম, জনাব মোশাররফ হোসেন, জনাব আলাউদ্দীন আহমদ এবং প্রাক্তন সিএসপি জনাব আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরী। আমাদের কোর্স পরিচালক ছিলেন কাজী সিরাজুল হোসেন। প্রশিক্ষণকালে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ বক্তাগণ আসতেন। সিআরপিসি পড়াতেন ঢাকার প্রথম ও বিখ্যাত সিএমএম জেড এ শামসুল হক, পেনাল কোড পড়াতেন ব্যারিস্টার কে জেড ইসলাম, সাক্ষ্য আইন পড়াতেন ব্যারিস্টার রফিকুর রহমান, মাইনর এক্টস পড়াতেন স্বনামখ্যাত আইন বিষয়ক লেখক ও বিচারক গাজী শামসুর রহমান এবং অ্যাডভোকেট ওজায়ের ফারুক। অফিস ব্যবস্থাপনা ও সার্ভিস রুলসের বিভিন্ন বিষয়ে মজার ক্লাশ নিতেন এএমএম বাহাদুর মুন্সী। উনার বাহাদুরী ও মুন্সীয়ানা এখনো মনে পড়ে যদিও তিনি বলতেন যে এ দু’টির কোনটিই তাঁর নেই। এছাড়াও বিভিন্ন অতিথি বক্তা আসতেন। বিশেষ করে মনে পড়ে তৎকালীন কাস্টমস কমিশনার শাহ আব্দুল হান্নান এর কথা, তিনি পরবর্তীতে এনবিআর চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ঐ সময়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে বড় ধরণের এক ঘড়ির চোরাচালান আটক করে তৎকালীন সিএমএলএ’র বিরাগভাজন হতেও পিছপা হননি। ১৯৬৫ ব্যাচের বিখ্যাত সিএসপি মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ’র একটি পরামর্শ আমি পুরো চাকুরি জীবনে অনুসরণ করে উপকৃত হয়েছি। তিনি বলেছিলেন বাসাকে যেন অফিস না বানাই, বাসায় বসে যেন অফিসের কাজ না করি। পারিবারিক জীবন যেন যতদুর সম্ভব আন-ডিস্টার্বড থাকে।
কোটাতে আবাসন সুবিধা ছিল ৬৪ জনের। আমাদের কাছে অপশন চাইলে যাদের বেশি প্রয়োজন তাদের কথা বিবেচনা করে আমি আবেদন করিনি। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ আমি তখন থাকতাম উত্তরা ৪নং সেক্টরে চাচা’র বাসায়। তখন উত্তরা কেবল গড়ে উঠছে, পুরো ৪ নং সেক্টরে ১০টির বেশি বাসা ছিল না। অভ্যন্তরীন রাস্তাগুলোর কাজ শেষ হয়নি। বর্ষাকাল, আমি জুতো হাতে নিয়ে ময়মনসিংহ রোডে এসে পা ধুয়ে, জুতো পড়ে বাসে উঠতাম। কিছুদিন যাবার পর বুঝতে পারলাম যে এভাবে চলতে পারে না। তখন হাতিরপুলে, কোটা থেকে হাঁটা পথের দূরত্বে, আমার ছোট মামা জনাব এম এ গনি’র বাসায় চলে এলাম। প্রশিক্ষণ কোর্সে সারাদিন ক্লাশ আর সারাদিন মজা উপভোগ করছিলাম। মেধাক্রমে প্রথম দিকে থাকায় আর তখনো ছাত্র বিধায়, মাঝে মধ্যেই ইন-কোর্স পরীক্ষা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, বয়সে সবার চেয়ে ছোট তাই সবার নজরেই ছিলাম।
সহকর্মীদের প্রায় সবাইকেই ভাই সম্বোধন করতাম। ব্যাচে প্রথম ছিলেন হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, যিনি পরে অর্থ বভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছেন। দ্বিতীয় ছিলেন নজরুল ইসলাম খান, এন আই খান নামে খ্যাত, যিনি শিক্ষা সচিব হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। তৃতীয় ছিলেন আমার বন্ধু সর্বদা প্রাণচঞ্চল মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন, যিনি ‘পে ইট ফরওয়ার্ড’ এর সঙ্গে যুক্ত। প্রশিক্ষণ চলাকালে ১৫ জুলাই ১৯৮৩ তারিখে বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচ এর চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়। এতে কোটা’য় থাকা ১৩৫ জনের মধ্যে ২৭ জন বিভিন্ন ক্যাডারে মনোনীত হন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিয়মিত ব্যাচে না গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে রয়ে যান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের প্রাক্তন সচিব মোহাম্মদ আবু নুর সিদ্দিক (এমএএন সিদ্দিক হবিগঞ্জে ম্যাজিস্ট্রেট ছিল শুরুতে) এবং মাহবুবুর রহমান পুলিশ ক্যাডার পেয়েও যোগদান করেন নাই। প্রত্যাশা মোতাবেক নিয়মিত ব্যাচের পরীক্ষায় পাশ করে আমি আরো নিশ্চিন্ত বোধ করলাম।
ইতোমধ্যে আইনে স্নাতক হিসেবে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে আব্বার পদায়ন হয় নোয়াখালী জেলায়। সেখানে ঘটনাক্রমে আমার এক মামা ছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, নোয়াখালী। ফলে আমরা আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে আব্বা অন্ততঃ এই বয়সে চাকুরীতে এসে থাকা খাওয়ার কোন অসুবিধায় পড়বেন না। তিনি নোয়াখালীতে গিয়ে ওই দপ্তরের রেস্টহাউজেই উঠলেন, পেছনেই মামা’র বাসা। এদিকে আমাদের প্রশিক্ষণও শেষ হয়ে আসছিল আর পদায়ন এর সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। এমন কেউ চেনা পরিচিত ছিল না যার সঙ্গে এই বিষয়ে পরামর্শ করতে পারি। এরই মাঝে একদিন চলে এলো শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিন, আমাদের পদায়ন আদেশ এলো, আর আমার পদায়ন হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার খাগড়াছড়ি মহকুমায়। ঢাকা থেকে বহুদূরে যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। সমাপনী উপলক্ষে অধ্যক্ষ ড. ফজলুল হাসান ইউসুফ তার ভাষণে সুরা আন নিসা থেকে বলেন “হে ঈমানদারগণ, ইনসাফের ধারক হও, ও খোদার ওয়াস্তে সাক্ষী হও। তোমাদের নিজেদের উপর কিংবা তোমাদের পিতা মাতা ও আত্মীয়দের উপরই পড়ুক না কেন, আর পক্ষদ্বয় ধনী কিংবা গরীব যাই হোক না কেন, তাদের সকলের অপেক্ষা খোদার এই অধিকার অনেক বেশি যে, তোমরা তার দিকেই বেশি লক্ষ্য রাখবে। অতএব নিজেদের বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে সুবিচার ও ন্যায় পরায়ণতা হতে বিরত থেকো না”। আমি জীবনে তা অনুসরণের চেষ্টা করেছি।