জালাল আহমেদ
১৯৪৬ সালে হবিগঞ্জে দাঙ্গা পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের উপরও হামলা হয়
আমার যে অভিজ্ঞতা তা হল আমরা যদি নিয়মিত, সময় করে পাঠ্য ও অপাঠ্য বইয়ের মাঝে একটা বিভাজন বা সময় বন্টন করে নেই তাহলে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। এখনকার যুগে আবার সোশ্যাল মিডিয়া’র জন্যও সময় বন্টন করতে হচ্ছে

আমি যে স্কুলে ৬ বছর পড়েছি, হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বাংলাদেশেরই অন্যতম সুন্দর ও আয়তনের দিক দিয়ে বড় স্কুল। শহরের দুই প্রধান সড়ক স্কুলের দুই পাশ দিয়ে গিয়েছে, স্কুলের সামনে দিয়ে গিয়েছে দুই প্রধান সড়ককে সংযোগকারী ক্রস রোড। স্কুলের পূর্বপাশের প্রধান সড়কের গেটকে বলা হত ব্যাক গেট। এটা ছিল আমার জন্য স্কুলে প্রবেশের গেট। সে গেট এর উল্টোপাশে একটা বড় বুকশপ ছিল, যার নাম ছিল সুলতানিয়া লাইব্রেরী। দোকানের যিনি ম্যানেজার সব সময়ই দোকানে থাকতেন, মালিক কখনো কখনো। আমি মাঝে মাঝেই লাইব্রেরী থেকে বই কিনতাম। স্কুল বিরতির সময় বিনা ব্যর্থতায় প্রায় প্রতিদিন ওই দোকানে যেতাম আর তৃষ্ণার্ত চাতকের মত তালাবদ্ধ ‘আউট বই’, পাঠ্যবই এর বাইরের বইয়ের তখনকার প্রচলিত নাম, এর আলমারীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। পরিচিত হয়ে যাবার পর ওই আলমারী আমার অধিকারে চলে আসলো। যার ফলে আউটবই এর আলমারীর অধিকাংশ বই, স্কুল বিরতি বা ছুটির পর প্রতিদিন ১০/২০ পৃষ্ঠা করে পড়ে ফেলতাম। আরেকটি পাঠাগার ছিল মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরী, মহকুমা পর্যায়ে এত সুন্দর পাঠাগার বাংলাদেশে আর ছিল কি-না সন্দেহ। একটি সুন্দর আটচালা ঘরের মাঝে ছিল সেই লাইব্রেরী, ভেতরে মাঝখানে ফাঁকা ছিল কিন্তু চারপাশে কাঠের পাটাতন বিশিষ্ট দোতলায় মূল্যবান বই এর সংগ্রহগুলো রাখা ছিল। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওই দোতলায় উঠতে হত। এত সুন্দর আর একটি পাঠাগার আমার চোখে পড়ে নাই। ৩২ খন্ডের এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা কেবল ওখানেই ছিল। এখন গুগল উইকি’র যুগে ছাপানো বিশ্বকোষ এর প্রয়োজনীয়তা তেমন অনুভূত হয় না কিন্তু তখন বিশ্বকোষ ছিল জ্ঞানচর্চার এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ।
একইভাবে কলেজ লাইব্রেরীর ব্যবহারও চলতে লাগলো। তবে পাঠ্য বই পড়ায় আমার যে প্রায়-অনাগ্রহ তার তেমন কোন উন্নতি হল না। আমার যে অভিজ্ঞতা তা হল আমরা যদি নিয়মিত, সময় করে পাঠ্য ও অপাঠ্য বইয়ের মাঝে একটা বিভাজন বা সময় বন্টন করে নেই তাহলে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। এখনকার যুগে আবার সোশ্যাল মিডিয়া’র জন্যও সময় বন্টন করতে হচ্ছে। এই সময় বন্টনে যে যত পারঙ্গম হবে তার জন্য সাফল্যও তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য হবে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে আমাদের স্কুলে ছাত্রদের হাউজ ভিত্তিক বিভাজন ছিল আর প্রথম হাউজ, যাতে আমি ছিলাম তা পড়ালেখায় সেরা হলেও খেলাধুলায় ছিলাম দুর্বলতম। ফলে অনেক খেলাতেই আমাকে দলনেতা হিসেবে বাধ্য হয়ে হলেও অংশ নিতে হত। কলেজে খেলাধুলায় অংশ নেবার বাধ্যবাদকতা না থাকলেও আমি নিয়মিত ছিলাম টেবলটেনিসে, প্রতিদিনই কিছু সময় কাটতো কমন রুমে টেবলটেনিস খেলে। কলেজ ক্রিকেট টিম এর ম্যানেজার এর দায়িত্ব পালন করেছি নিজ শহরে এবং শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারে।
১৯৭৭ এর কোন এক সময়ে হবিগঞ্জে সস্ত্রীক বেড়াতে এলেন বাংলাদেশে তৎকালীন হাইকমিশনার জনাব মোহাম্মদ খুরশিদ। তিনি আমাদের কলেজেও এলেন। জনাব মোহাম্মদ খুরশিদ তরুণ আইসিএস অফিসার হিসেবে ১৯৩৫-৩৭ সালে হবিগঞ্জে এসডিও ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৪৫-৪৬ ও ১৯৪৭-৪৯ সালে তিনি সিলেটে ডিসি ছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সিলেট তখন আসাম প্রদেশে ছিল এবং আসামে জেলা প্রশাসকদের ডেপুটি কমিশনার পদবি ছিল যা বেঙ্গলে ছিল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বেঙ্গল তথা ইস্ট পাকিস্তানে এই পদবি ১৯৬১ পর্যন্ত চালু ছিল। ১৯৬১ তে এসে ইস্ট পাকিস্তানে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের পদবি ডেপুটি কমিশনার করা হয়। মোহাম্মদ খুরশিদ সাহেব যখন ডিসি সিলেট তখন ১৯৪৬ সালে হবিগঞ্জে এক দাঙ্গা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জেলা প্রশাসক নিজে চলে আসেন। বৃন্দাবন সরকারি কলেজের সামনে লোকাল বোর্ড এর অফিস (যেখানে এখন মিলনায়তন করা হয়েছে), যা আসাম প্রদেশের মহকুমা পর্যায়ের স্থানীয় সরকার ছিল, অফিসের পেছনে মাঠ, জালাল স্টেডিয়াম (তখনো এই নাম হয়নি)। দাঙ্গাকারীরা মাঠের দুই পাশে জড়ো হচ্ছিল। জেলা প্রশাসক দারুণ সাহস দেখিয়ে মাঠের মাঝখানে দাঙ্গাকারীদের মাঝে চলে যান। এক পর্যায়ে দুই পক্ষই যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠে পরস্পরকে আক্রমণ করে, মাঝখানে জেলা প্রশাসকের উপরও হামলা হয়, কেউ একজন জেলা প্রশাসককে আঘাত করলে অন্য একজন নিজের শরীরে আঘাত নিয়ে জেলা প্রশাসককে রক্ষা করেন। ডিসির উপর আঘাত লেগেছে এই শোর উঠাতে দাঙ্গাও থেমে যায়। জেলা প্রশাসক অল্পের উপর রক্ষা পান। যে ছেলে নিজের গায়ে আঘাত নিয়ে ডিসিকে রক্ষা করেছিল ডিসি সেই ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং তাকে সিলেটে নিজের কাছে নিয়ে যান। পরে তার চাকুরীর ব্যবস্থা করেন, তিনি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান, তাকে সঙ্গে নিয়ে যান। ১৯৭৭ সালে যখন তিনি আমাদের কলেজে এলেন তখনো ১৯৪৬ সালে ডিসিকে রক্ষাকারী ঐ লোক হাইকমিশনারের সঙ্গে। ঐ লোকের বাড়ি ছিল শহরের শায়েস্তানগর এলাকায়, সে তাঁর বাড়িতেও বেড়াতে যায়।
মোহাম্মদ খুরশিদ সস্ত্রীক কলেজ প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন। আমরা কেউ কেউ তার সঙ্গে হাঁটতে থাকি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন তাঁর চেয়ে লম্বা। এর কিছুদিন আগে যখন হেনরী কিসিঞ্জার ভারত সফরে এসেছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী কুতুবমিনার এর নিকটে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের অভ্যন্তরে গুপ্তযুগের বিখ্যাত লৌহস্থম্ভ দু’হাত পেছনে দিয়ে বেষ্টন করার চেষ্টা করেছিলেন, এতে নাকি ইচ্ছা পূরণ হয়। কিসিঞ্জারের স্ত্রীও তাঁর চেয়ে লম্বা ছিলেন। মোহাম্মদ খুরশিদ দম্পতিকে দেখে সেই দম্পতির কথা আমার মনে পড়ছিল। কলেজ চত্বরে কিছুক্ষণ হেঁটে তিনি চলে যান। রাতে বাসায় আব্বার কাছে শুনি যে তিনি পরে হবিগঞ্জ শহরে দুজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট এর বাসায়ও যান তাদের সঙ্গে দেখা করতে যারা তিনি যখন এসডিও ছিলেন তখন তাঁর আদালতে মোক্তার হিসেবে প্র্যাকটিস করতেন। তারপর তিনি হবিগঞ্জ ত্যাগ করেন। একটা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হল যে মোহাম্মদ খুরশিদ এর আপন ভাইয়ের ছেলে বর্তমান মন্ত্রীসভায় একজন পূর্ণ মন্ত্রী।
আমার কাছে একটি আত্মজীবনী আছে যার লেখক ডাব্লিউ এইচ সমারেজ স্মিথ, বইটির নাম ‘এ ইয়ং মেন’স কান্ট্রি’, লেখক ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য ছিলেন। রাজশাহীতে শিক্ষানবিশ কাল কাটিয়ে মাদারীপুর মহকুমায় এসডিও হন ১৯৩৬ সালে। তখন এসডিপিও মাদারীপুর ছিলেন জনাব একেএম হাফিজউদ্দিন, যিনি ১৯৫৮-১৯৬২ আইজিপি ছিলেন, বইটি তাকেই উৎসর্গ করা। তখন ডিসি ফরিদপুর ছিলেন ১৯২২ ব্যাচ এর আইসিএস কেএএল হিল। স্মিথ সাহেব মাদারীপুর থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে মিশনারী হয়ে যান এবং ১৯৭৫ সালে মিশনারী কাজ থেকে অবসর নিয়ে ১৯৭৬ সালে আবার মাদারীপুর বেড়াতে আসেন এবং ১৯৩৬ সালে প্র্যাকটিস করা দু’জন মোক্তার তখনো জীবিত জেনে তাঁদের বাসায় যান দেখা করতে। আমি পরে খুরশিদ আহমেদ সাহেবের ভিজিটকে এই ভিজিটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিলাম।