স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনসহ দেশের এবং হবিগঞ্জের প্রতিটি ন্যায় সঙ্গত আন্দোলনের সাথে ছিলেন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত। তিনি কখনও নীতির সাথে আপোষ করেননি। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন সকলের নিকট উদাহরণ। হবিগঞ্জের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন সকলের অভিভাবক। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনীতির অনন্য রূপকার। মাতৃভাষা বাংলা ও দেশের প্রতি ছিল তার অসাধারণ অনুরাগ। এটি তিনি যেমন মনে লালন করতেন তেমনিভাবে কর্মের মাঝেও প্রমাণ করতেন। তাঁর মৃত্যুতে হবিগঞ্জ তথা জাতি হারিয়েছে এক সূর্য সন্তানকে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় তার এই শূন্যতা অপূরণীয়।
মঙ্গলবার বিকেলে হবিগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মানিক চৌধুরী পাঠাগারের উদ্যোগে ভাষা সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত স্মরণে শোকসভায় আলোচকরা এসব কথা বলেন। হবিগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মানিক চৌধুরী পাঠাগারের সভাপতি ও সরকারি বৃন্দাবন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ইকরামুল ওয়াদুদ এর সভাপতিত্বে শোকসভায় আলোচনায় অংশ নেন ন্যাপ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট স্বদেশ রঞ্জন বিশ্বাস, অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ভট্টাচার্য্য, অ্যাডভোকেট ইসমাইল হোসেন, অ্যাডভোকেট স্বরাজ রঞ্জন বিশ্বাস, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, ইসকনের অধ্যক্ষ উদয় গৌর ব্রহ্মচারী, অ্যাডভোকেট ইমান উল্ল্যাহ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ, জেলা গণফোরাম সভাপতি অ্যাডভোকেট শ্যামল কুমার চৌধুরী, আলী আহম্মদ খান, কমরেড হাবিবুর রহমান, পিযূষ চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট আব্দুল হান্নান, অধ্যক্ষ রফিক আলী, অ্যাডভোকেট মুরলী ধর, আব্দুল কুদ্দুছ, অনুপ কুমার দেব মনা ও মরহুম আফরোজ বখত এর সন্তান অ্যাডভোকেট সৈয়দ সামায়ুন বখত। অনুষ্ঠানে মরহুম সৈয়দ আফরোজ বখত এর কর্মময় জীবনের তথ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রবীন আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত (৮৬) ইন্তেকাল করেন।
সৈয়দ আফরোজ বখত এর সংক্ষিপ্ত জীবনী ঃ আফরোজ বখত ১৯৫২ সালে ছিলেন মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মাতৃভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে ছিলেন সংগঠক। হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পায়ে হেঁটে তিনি সংগঠিত করতেন ছাত্রছাত্রীদের। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার পর থেকে কর্মক্ষেত্রে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার ব্যবহার করেননি তিনি। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হলেও তিনি কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করতেন না। মামলার আরজি, জবাব সবই লিখতেন বাংলায়। ১৯৫৫-১৯৫৬ সেশনে সরকারি বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ন্যাপ (ওয়ালি-মোজাফফর) হবিগঞ্জ মহকুমার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা সিভিল ডিফেন্স একাডেমিতে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ ইং সনে পাক ভারত যুদ্ধের সময় ঢাকাতে সিভিল ডিফেন্স ওয়ার্ডেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গঠিত কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইয়ুব আন্দোলন গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি হবিগঞ্জ শাখার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক হবিগঞ্জ মহকুমা স্বাধীনতা আন্দোলনের গঠিত সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৭ সনে তিনি হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এই সমিতির তিনবারের সভাপতি এবং একবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। হবিগঞ্জ মহকুমার জিপি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বাকশাল গঠিত হলে হবিগঞ্জ শাখার তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৮৩ সনে রাশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে রাশিয়া ভ্রমন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৮ জুলাই তিনি হুসনে আরা কোরেশির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের মহিলা সম্পাদক। অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ সামায়ুন বখত আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন। সৈয়দ হুমায়ুন বখত ব্যাংকার এবং সৈয়দ সাইমুন বখত বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী। একমাত্র মেয়ে ডাঃ সৈয়দা ইসরাত জাহান দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন এবং সেখানেই এমআরসিপি সম্পন্ন করেন।
অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত হবিগঞ্জ বারে আইন পেশায় ৫০ বছর অতিক্রম করায় সমিতি তাঁকে সংবর্ধনা দেয় এবং স্বর্ণপদক প্রদান করে।