এমপি আবু জাহিরসহ বিভিন্ন মহলের শোক
স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জের প্রবীন আইনজীবী, ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত (৮৬) আর নেই। গতকাল বুধবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে অসুস্থ অবস্থায় তাকে সিলেট নেয়ার পথে নবীগঞ্জে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আজ সন্ধ্যা ৭টায় হবিগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করবে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা প্রশাসন। পরে বানিয়াচং উপজেলার করচা গ্রামে ২য় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে। তবে এখনও ২য় জানাজার সময় চুড়ান্ত হয়নি। মৃত্যুকালে সৈয়দ আফরোজ বখত স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রেখে গেছেন।
আফরোজ বখত ১৯৫২ সালে ছিলেন মেট্রিক পরীক্ষার্থী। মাতৃভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে ছিলেন সংগঠক। হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে পায়ে হেঁটে তিনি সংগঠিত করতেন ছাত্রছাত্রীদের। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার পর থেকে কর্মক্ষেত্রে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার ব্যবহার করেননি তিনি। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হলেও তিনি কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করতেন না। মামলার আরজি, জবাব সবই লিখতেন বাংলায়। অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত ১৯৩৫ সালের ৩১ মার্চ বানিয়াচং উপজেলার করচা গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ খুরশেদ আলী ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। তিনি প্রাইমারী স্কুলে লেখাপড়া করেন মথুরাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সন্দলপুর বিসিএমই স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে মিডল ইংলিশ স্কুল লিবিং সার্টিফিকেট পরীক্ষায় পাশ করেন। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। পরে সরকারি বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হয়ে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে যান। ১৯৫৩ সালে এইচএসসি পাশ করার পর সেখানেই ¯œাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৫-১৯৫৬ সেশনে কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ’৫৮ সালে বিএ পাশ করেন। ’৬৫ সনে ঢাকা সিটি ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। ওই সময়ে কিছুদিন মহাহিসাব রক্ষণ অফিসে চাকুরীও করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ন্যাপ (ওয়ালি-মোজাফফর) হবিগঞ্জ মহকুমার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা সিভিল ডিফেন্স একাডেমিতে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ ইং সনে পাক ভারত যুদ্ধের সময় ঢাকাতে সিভিল ডিফেন্স ওয়ার্ডেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গঠিত কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইয়ুব আন্দোলন গঠিত ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি হবিগঞ্জ শাখার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক হবিগঞ্জ মহকুমা স্বাধীনতা আন্দোলনের গঠিত সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি তখন ভারতের ত্রিপুরায় খোয়াই মহুকুমা এসডিও জে পি গুপ্ত, আইসিএস অরুণ কর (পরবর্তীতে ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী), ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, ত্রাণ বিভাগের মহাপরিচালক সায়গলসহ আরও সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাদের সহযোগিতায় শরণার্থী শিবিরের বহু সমস্যার সমাধান করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করে উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। এর আগেই ১৯৬৭ সনে তিনি হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এই সমিতির তিনবারের সভাপতি এবং একবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। হবিগঞ্জ মহকুমার জিপি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বাকশাল গঠিত হলে হবিগঞ্জ শাখার তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৮৩ সনে রাশিয়া সরকারের আমন্ত্রণে রাশিয়া ভ্রমন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৮ জুলাই তিনি হুসনে আরা কোরেশির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী ছিলেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের মহিলা সম্পাদক। অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সৈয়দ সামায়ুন বখত তার সাথে আইন পেশায় জড়িত রয়েছেন। সৈয়দ হুমায়ুন বখত ব্যাংকার এবং সৈয়দ সাইমুন বখত বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী। একমাত্র মেয়ে ডাঃ সৈয়দা ইসরাত জাহান দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পর ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন এবং সেখানেই এমআরসিপি সম্পন্ন করেন।
অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত হবিগঞ্জ বারে আইন পেশায় ৫০ বছর অতিক্রম করায় সমিতি তাকে সংবর্ধনা দেয় এবং স্বর্ণপদক প্রদান করে।
এমপি আবু জাহিরের শোক ঃ ভাষা সৈনিক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির এমপি। গতকাল রাতে সংবাদপত্রে প্রেরিত এক শোকবার্তায় তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
জি কে গউছের শোক ঃ ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ও টানা ৩ বারের নির্বাচিত হবিগঞ্জ পৌরসভার পদত্যাগকারী মেয়র আলহাজ্ব জি কে গউছ। তিনি গতকাল বুধবার সংবাদপত্রে প্রেরিত এক শোকবার্তায় মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। শোক বার্তায় জি কে গউছ বলেন- সৈয়দ আফরোজ বখত ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ভাষা সৈনিক। তিনি হবিগঞ্জের অহংকার, হবিগঞ্জের গর্ব। ২০০৪ সালে আমি হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পৌরসভায় আমার শেষ কর্ম দিবস পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। কিভাবে পৌরসভাকে সুন্দর করা যায়, পৌরবাসীকে উন্নত সেবা দেয়া যায়, জনদুর্ভোগ লাঘব করা যায়, সেই সব বিষয়ে অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত সাহেব আমাকে দিক দির্দেশনা দিয়ে সহযোগিতা করতেন। আমি উনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। উনার মৃত্যুতে হবিগঞ্জবাসী একজন অভিভাবক হারালো। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৯৫ ব্যাচ এসোসিয়েশনের শোক ঃ হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৯৫ ব্যাচ এসোসিয়েশনের সদস্য সৈয়দ ইমনের পিতা ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখ্ত এর ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করেছেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ৯৫ ব্যাচ এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ মরহুমের রূহের মাগফেরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
এছাড়াও অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত এর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল।