জালাল আহমেদ
আমার সমবয়সী শিশুদের মধ্যে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হতো ॥ সবচেয়ে অবাক বিষয় ছিল যুদ্ধে টিক্কা খান বা নিয়াজী হবার জন্য কোন ভলান্টিয়ার পাওয়া যেত না, সবাই ওসমানী হতে চাইতো

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে তেলিয়াপাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোতে ২ ইস্টবেঙ্গল ও ৪ ইস্টবেঙ্গল এর যৌথ সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোতে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী সেনা কর্মকর্তাদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে কর্ণেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, লেঃ কর্ণেল মোহাম্মদ আব্দুর রব, লেঃ কর্ণেল এস এম রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নূর উজ জামান, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলামসহ আরো কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। ভারতীয় বিএসএফ প্রধান রুস্তমজী, ব্রিগেডিয়ায়ার ভিসি পান্ডে, আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া’র মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দিনও এ সভায় যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় কর্ণেল (অবঃ) এমএজি ওসমানীকে। সভায় সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। পরে ১১ এপ্রিল ৮টি সামরিক অঞ্চলে ও ১৯৭১ এর জুলাই মাসে সারাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই হবিগঞ্জ জেলায় অনুষ্ঠিত এই সভা মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সারাদেশে প্রতিরোধের এই প্রাথমিক সাফল্য দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকে এবং পাকবাহিনী দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা সদর সমূহে অবস্থান নিতে থাকে। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে পাকবাহিনী হবিগঞ্জে প্রবেশ করে। তার আগেই আমাদের পরিবারের সবাই শহর ত্যাগ করে লাখাই উপজেলার পশ্চিম বুল্লা গ্রামে চলে যাই।
আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে আমি বুল্লবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৬৮ সালে ক্লাশ ফোরে পড়েছি। এবারতো আর পড়ালেখা নাই। গল্প আড্ডা আর খেলাধূলা। আমার তিন মামা থাকতেন বাড়িতে। এক মামা ঠিকাদার ছিলেন, বাজারে তাঁর ব্যবসাও ছিল। আরেক মামা জমিজমা দেখতেন, সেচ প্রকল্প ছিল আর বাজারে ব্যবসা। আরেক মামা মূলতঃ গল্প গাছা করেই সময় কাটাতেন এবং এই মামাই ছিলেন আমাদের সবার প্রিয়। অনেক কাজিন ছিল বিধায় আনন্দের উৎসের কোন অভাব ছিল না। কিন্তু যুদ্ধের উত্তাপও মাঝে মাঝে আমাদের স্পর্শ করছিল। আমার ছোটমামা ছিলেন ঢাকায়, মোজাফফর ন্যাপ এর ধানমন্ডি থানা কমিটির সভাপতি। ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের পর তিনি সপরিবারে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জ চলে যান। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে মামী এবং ছোট দুই বাচ্চাসহ ৪ দিনে বাড়িতে পৌঁছান। ছোট মামা পরে আবার আমার ছোট চাচাসহ ঢাকার অন্য মামা এবং বড়চাচার খোঁজ নিতে ভৈরব হয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকা থেকে আবার ডেমরা হয়ে ঘোড়াশাল হয়ে পায়ে হেঁটে ভৈরব যান, ভৈরব থেকে লঞ্চে মাদনা হয়ে বুল্লা ফিরে আসেন।
সিলেটে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগে যে মামা ছিলেন তাঁদের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। নানা-নানীর তাড়নায় আব্বা ও বড়মামা তাঁদের খোঁজ নিতে সিলেটে যান। কিন্তু তাঁরা যে গেলেন, কিভাবে গেলেন বা যাচ্ছেন, পৌঁছেছেন কি না কোন খবর ছিল না। আমরা প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি এই বুঝি কোন খবর আসলো। সম্ভবতঃ সিলেট যাবার ১০/১২ দিন পর তাঁরা একদিন সুতাং নদীর ঘাটে এসে হাজির হলেন। পরে শুনলাম তাঁরা নয় মাইল পায়ে হেঁটে হবিগঞ্জ, তারপর রিকশা করে হবিগঞ্জ থেকে ধুলিয়াখাল হয়ে মীরপুর আসেন। মীরপুর থেকে হেঁটে শ্রীমঙ্গল, শ্রীমঙ্গল থেকে বাসে মৌলভীবাজার, মৌলভীবাজার থেকে বেবীটেক্সিতে শেরপুর ও শেরপুর থেকে বাস ও রিকশায় সিলেট গিয়ে পৌঁছান। সিলেট গিয়েও মামার কোন খবর পাচ্ছিলেন না। অনেক অনুসন্ধানের পর জানতে পারেন যে মামা শালুটিকরের পেছনে সারি-গোয়াইন নদীর ওপারে ইজ্জত আলী কন্ট্রাক্টরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। আব্বা আর মামা বহু কষ্টে সে বাড়িতে গেলেন, কয়েকদিন থেকে একটা বড় নৌকা জোগাড় করলেন তারপর নৌকায় করে ৪ দিনে বুল্লা পৌঁছালেন। ইজ্জত আলী’র বাড়িতে মামার সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের আরও তিনটি পরিবারের সদস্যরা ছিল। তাঁদের বাড়ি ছিল কুমিল্লা। তাঁরাও একইসঙ্গে ঐ নৌকায় করে বুল্লা আসলেন। পথে দু’রাত থাকতে হয়েছে, এক রাত নৌকায় আরেক রাত ছিলেন ভাটি অঞ্চলের অত্যন্ত পরিচিত বাড়ি আজমিরীগঞ্জ এর হাফিজ উদ্দিনের (হাফাই মিয়া) বাড়িতে।
আব্বা ১৯৫৫ সালে আজমিরীগঞ্জ এর সহকারী তহসীলদার ছিলেন, আর হাফিজ উদ্দিন এর ভাই প্রাক্তন এমপি রফিক সাহেব ছিলেন আমার ছোট মামার বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই সবাইকে নির্দ্বিধায় সহযোগিতা করেছে আর এখানে পরিচিত থাকাতে তাঁরা ভালোভাবেই রাত কাটাতে পেরেছেন। কিন্তু নৌকা যখন চলেছে তখন মহিলারাসহ অন্যরাও নৌকার পাটাতনের নীচে লুকিয়ে থাকতেন। ওই তিন পরিবারসহ মামারা পৌঁছালে নানাবাড়িতে ৫ মামার পরিবার, আমাদের পরিবার ও ৩ অতিথি পরিবার নিয়ে মোট ৬০/৭০ জন মানুষ, বাড়ি ছিল জমজমাট। নিঃসন্দেহে এটা ছিল দশ বছরের বালকের জন্য এক অন্যরকম অনুভূতি। পরিবারের কর্তাদের অনুভূতি অবশ্যই আলাদা ছিল। নিরাপত্তাসহ এতোগুলো মানুষের খাবার-দাবারের বিষয়েও তাদের দেখভাল করতে হতো। আরও পরে আমরা জানতে পারি যে দিনাজপুরে থাকা আমার অন্য মামা সপরিবারে ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও সংগঠিত হতে শুরু করেন এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্য থেকেও কিশোর যুবকদের কেউ কেউ নাই হয়ে যাচ্ছিল ভারতের পথে। ‘কাক উড়া’ দূরত্বে তেলিয়াপাড়া বা আখাউড়া লাখাই থেকে খুব দূরে না হওয়ায় ঐ সকল এলাকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের আর্টিলারি ফায়ারের শব্দ আমরা বুল্লা থেকেও শুনতে পেতাম।
এদিকে নিজেদের কাজিন এবং অতিথি তিন পরিবারের বাচ্চারা মিলে আমরা বেশ বড় একটা দল। সঙ্গে গ্রামের ছেলেরাতো আছেই। চারিদিকে মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা আমাদেরও স্পর্শ করছিল। রাতে নিয়ম করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা, চরমপত্র আর দেশাত্ববোধক গান আর লোক মুখে নানান খবর। আমাদের পর্যায়েও কথা বলতে বলতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু হয়ে গেলো। পাটখড়ির বেড়া ঘেরা দিয়ে বাঙ্কার আর পাটখড়ির তীর, বাঁশের ধনুক দিয়ে যুদ্ধ, তীর কারো গায়ে লাগলে সে আহত, সাময়িক আউট, গুরুত্বপূর্ণ অংগে লাগলে ঐ দিনের জন্য আউট। বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত আমাদের এই খেলা চলতে লাগলো। সবচেয়ে অবাক হবার বিষয় ছিল যুদ্ধে টিক্কা খান বা নিয়াজী হবার জন্য কোন ভলান্টিয়ার পাওয়া যাচ্ছিল না, সবাই জেনারেল ওসমানী হতে চাইতো।