জালাল আহমেদ
আমার নানাবাড়ি ছাড়া পশ্চিম বুল্লা গ্রামে আর কোন শিক্ষিত পরিবার ছিল না
১৯৭০ এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে হবিগঞ্জ-লাখাই-মাধবপুর আসনে অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ-নবীগঞ্জ আসনে লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এম এ রব ও চুনারুঘাট-বাহুবল-শ্রীমঙ্গল আসনে এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) জয়লাভ করেন। প্রাদেশিক পরিষদে হবিগঞ্জ-লাখাই আসনে ডাঃ আবুল হাসেম, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ আসনে গোপালকৃষ্ণ মহারতœ, নবীগঞ্জ আসনে আব্দুল আজিজ চৌধুরী, চুনারুঘাট-বাহুবল আসনে এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) ও মাধবপুর আসন থেকে মৌলানা আছাদ আলী নির্বাচিত হন

সারা দেশই তখন উত্তপ্ত স্বাধিকার এর চেতনায়। ইয়াহিয়া খান বহু টালবাহানার পর নির্বাচন দিলেন। এর মাঝে ১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের উপকূলে লক্ষ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করলো। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কোন ব্যবস্থাই নিল না। উপদ্রুত এলকা ঘুরে এসে পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর বিখ্যাত উক্তি “ওরা কেউ আসে নাই”! এ অবস্থায়ই ১৯৭০ এর ৮ ডিসেম্বরের যুগান্তকারী নির্বাচন। আমার আব্বা এডভোকেট আব্দুর রহমান আওয়ামী লীগের সদরের এমপি প্রার্থী ডাঃ আবুল হাশেম এর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। উনার মেয়ে ফারহানা হাশেম এক সময় সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন, পরে ছেড়ে যান। নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক উভয় পরিষদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ২৮৮ আসন। জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৬০ আসন (সম্ভাব্য ৭টি মহিলা আসন ধরে ১৬৭ বলা হয়ে থাকে)। উক্ত নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে হবিগঞ্জ-লাখাই-মাধবপুর আসনে এডভোকেট মোস্তফা আলী, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ-নবীগঞ্জ আসনে লেঃ কর্নেল (অবঃ) এম এ রব ও চুনারুঘাট-বাহুবল-শ্রীমংগল (আংশিক) আসনে এ কে লতিফুর রহমান চৌধুরী (মানিক চৌধুরী) জয়লাভ করেন। প্রাদেশিক পরিষদে হবিগঞ্জ-লাখাই আসনে ডাঃ আবুল হাসেম, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ আসনে গোপালকৃষ্ণ মহারতœ, নবীগঞ্জ আসনে আব্দুল আজিজ চৌধুরী, চুনারুঘাট-বাহুবল আসনে এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) ও মাধবপুর আসন থেকে মৌলানা আছাদ আলী নির্বাচিত হন। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮ আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টো’র পাকিস্তান পিপলস পার্টি লাভ করে ৮১ আসন। ফলে কেন্দ্রে ও প্রদেশে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক-সামরিক নেক্সাস এই ফল মেনে নিতে বা তদনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে তৈরী ছিল না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও জুলফিকার আলী ভুট্টো’র কথায় স্থগিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছুই পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণে বংগবন্ধু আমাদের করনীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়ে দেন। কিন্তু পাকিস্তানী সামরিক সরকার জনরায়ের বিপরীতে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহন করে এবং ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ ঝাঁপিয়ে পরে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। কিন্তু আমরা একেবারে অপ্রস্তুত ছিলাম না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ফলশ্রুতিতে ঘরে ঘরে বাস্তব দুর্গ গড়ে না উঠলেও যে মানসিক দুর্গ গড়ে উঠে তাই দিয়ে সারাদেশের মানুষ সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ২৬ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হবার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন আর আমরা পাই একটি স্বাধীন দেশ যা হানাদারদের কবলে। পাকবাহিনী ধীরে ধীরে সারা দেশে তাদের দখল কায়েম করতে থাকে এবং সব জায়গায় পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে এগুতে থাকে। সারাদেশে বিভিন্ন সেনা ইউনিটে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাগন এবং কোথাও কোথাও পুরো ইউনিট বিদ্রোহ করে পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে এবং বেরিয়ে এসে জনযুদ্ধের অংশ হয়ে যায়। ১৯৭১ এর ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জ এর তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকল সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ গণপরিষদের সদস্যগন স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র অনুমোদন করেন ও ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহন করে।
২৬ মার্চ ১৯৭১ এর আগে থেকেই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত হবিগঞ্জেও যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ওইদিন বর্বর পাক হানাদারগন নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে এই সংবাদ হবিগঞ্জেও পৌঁছে যায় ফলে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৬ মার্চ রাতেই এডভোকেট মোস্তফা আলী এমএনএকে আহবায়ক ও ডাঃ শামসুল হোসেনকে সাধারন সম্পাদক করে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী (এমএনএ) প্রথমে মাধবপুরে প্রতিরোধের উদ্যোগ নেন, মাধবপুর থানার ১২ জন কনেস্টবল অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয়। পরে যখন জানা যায় যে পাক আর্মি সিলেট থেকে আসবে তখন নেতৃবৃন্দ হবিগঞ্জে বসে করনীয় ঠিক করেন। ২৭ মার্চ তৎকালীন এসডিও আকবর আলী খান ট্রেজারী থেকে ৫৫০টি রাইফেল ও ২০ হাজার গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে হস্তান্তর করেন। যে বিষয়ে পরে সামরিক আদালতে এসডিওসহ হবিগঞ্জের অনেক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এতে আকবর আলি খানের ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ডাদেশ হয়। এই অস্ত্র গুলি নিয়ে লেঃ কর্ণেল এম এ রব (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল, মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ ও বীরউত্তম), মেজর সি আর দত্ত (পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার, মেজর জেনারেল ও বীরউত্তম) এবং কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী (এমএনএ) শ্রীমঙ্গলের পথে রশীদপুরে যান।
১৯৭১ এর এপ্রিলের শেষে যখন পাকবাহিনী হবিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে তখন আমরা শহর ত্যাগ করে হাওরাঞ্চলে আমার নানা বাড়িতে চলে যাই। ১৯৭১ সালের প্রায় পুরোটাই স্কুলের বাইরে, হাওরাঞ্চলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে পার করে দেই। হাওরের ওই এলাকায় তখনো রাস্তাঘাট নেই। মহকুমা সদর থেকে থানা সদরে রাস্তা নামে যা ছিল তা বর্ষায় ডুবে যেতো এবং রাস্তাও একটানা নয়। হবিগঞ্জ থেকে ৮/৯ কিলোমিটার পর সুতাং নদী। নদীতে কখনো জুরিন্দা, দুটো বারকী নৌকাকে যুক্ত করে পাটাতন দেয়া হত গাড়ি তোলার জন্য, ফেরী থাকতো। ২৪ কিলোমিটার রাস্তায় অন্তত ১৫/২০টা ‘ভাঙ্গা’ ছিল যা’ বর্ষার শুরুতে প্রথমে খাল পরে নদী হয়ে যেত। ‘ভাঙ্গা’গুলো ছিল মূলতঃ ‘গোপাট’, গোপথ, গ্রাম থেকে হাওরে চড়ানোর জন্য গরু নিয়ে যাবার ওপেনিং। ১৯৭০ সালে এর অনেকগুলোর উপর মজবুত বাঁশের তৈরি সেতু ছিল। যে হাওরে এখন আমরা মাইলের পর মাইল ধানী জমি দেখি তার প্রায় সবটুকুই ১৯৭০-১৯৭১ এ গোচারণ ভূমি বা গ্রেজিং ল্যান্ড ছিল। ফলে গোয়াল ভরা গরু ছিল কমন। যে গৃহস্থের একটু বেশি জমি ছিল তার গোয়াল ভর্তি গরু না থাকলে তো চাষ-মাড়াই দেয়া সম্ভব হত না। ফলে গরু ছিল ঘরে ঘরে। আমার নানা বাড়িতেও তখন গোয়াল ভর্তি গরু, দুধ মাখনে ভরপুর। ফলে শীতকালে কখনো কখনো সরকারী কোন জীপ ওই পথে গেলেও মাঝে মাঝেই জমির উপর দিয়ে ‘ক্রস-কান্ট্রি’ যেতে হতো। সাধারণ মানুষের জন্য ‘বাইস্যায় নাও, হেউতায় পাও’ ছিল ভরসা।
আমার নানাবাড়ি ছিল আমার জন্মস্থান। ওই সময়ের প্রথা অনুযায়ী অধিকাংশ সন্তানের জন্ম মাতুলালয়েই হতো। আমার মা ছিলেন আমার নানা-নানীর একমাত্র মেয়ে, সাত ছেলের পর এক মেয়ে হওয়ায় আমার মায়ের এবং সেই ধারাবাহিকতাক্রমে আমার আদরও একটু বেশিই ছিল। হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলে জনবল-গোষ্ঠী আর জমিজমার একটা গুরুত্ব ছিল। আমার নানাবাড়ি ছাড়া লাখাই উপজেলার পশ্চিম বুল্লা গ্রামে ওই সময়ে আর কোন শিক্ষিত পরিবার ছিল না। বড়মামা আবদুল হেকিম ঠিকাদারী ও ব্যবসা করতেন। মেজমামা বাড়িতেই থাকতেন। চতুর্থ মামা নুরুজ মিয়া সেচপ্রকল্প সহ বিরাট গৃহস্থি সামলাতেন। আমার ৪ মামা বিভিন্ন পেশায় বাড়ির বাইরে থাকতেন। তৃতীয় মামা ফিরোজ আহমেদ ১৯৪৬ সালে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক ও এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েছেন। আর ষষ্ঠ মামা এম এ করিমও ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। এরা দুজনেই চাকুরী করতেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে। পঞ্চম মামা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ কম্যুনিস্ট পার্টি করতেন, পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারী হয়, তিনি লাখাই থেকে দিনাজপুর চলে যান ও সেখানেই স্থায়ী হয়ে যান, পরবর্তীতে তিনি ঠিকাদারী পেশায় ভালো করেন। সপ্তম মামা এম এ গনি হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, নটরডেম কলেজে ও জগন্নাথ কলেজে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তিনি জগন্নাথ কলেজে পড়াতেন কিন্তু পরে পুরো সময়ের বামপন্থী রাজনীতিবিদ হয়ে যান। তিনি লাখাই থানা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ১৪ দলীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য, আমার বড় চাচা ডাঃ এম এ মাননান ১৯৪৭ সালে হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক, এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৯ সালে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন ও ১৯৫৪ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ছোট চাচা আবদুল মজিদও ছিলেন শিক্ষক।