জালাল আহমেদ
হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ‘আলীম-মালিক-নবী স্যার এর মুক্তি চাই’ বলে মিছিল করেছি

১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি হবিগঞ্জ এর বাইরে ছিলাম। জন্মের পর থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কাটিয়ে ১৯৬৮ সালে আমি হবিগঞ্জ এর হাওরাঞ্চলে, লাখাই উপজেলায় আমার নানা বাড়ির এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। চট্টগ্রামে পড়েছি জামালখান এলাকায় সেন্ট মেরী স্কুলে, যে স্কুলে ৩০ বছর পর ১৯৯৪ সালে আমার ছেলেও ভর্তি হয়েছিল। তারপর ধানমন্ডি হাই স্কুল ঢাকা। দুর্গম ওই উপজেলার সড়কে গাড়ি চলেছে ১৯৯৭ সালের পর। এটা ছিল একটা কালচারাল শক এর মত। আমার বড় বোনের খুব একটা অসুবিধা না হলেও আমার মানিয়ে নিতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। বাড়ির পশ্চিমে সংলগ্ন মসজিদে অন্য মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে আরবী পড়া বাধ্যতামূলক। আমি এর আগে আরবী পড়ি নাই। ফলে ৮ ছর বয়সে আরবী শুরু করা ও কঠিন ছিল। আর ছিল সবার মাঝে থেকেও নিঃসঙ্গতা, এতোদিন পরেও এর কারনটা আমি ঠিক বুঝি না। আমরা যে ঘরে থাকতাম তা’ ছিল অনুমান ১২০ ফিট লম্বা একটি “কাঠ-কেওয়ারী” দেড়তলা ঘর। হাওরাঞ্চলে এরকম কাঠের বাড়ি তখন যেকোন সম্পন্ন পরিবারেই থাকতো। মুল ঘরে ছিল ৫ টি বিরাট কক্ষ আর লম্বা টানা ৮০ ফিট বারান্দার দুই মাথায় আরো দু’টি রুম। ওই দু’টি রুমের আবার কাঠের পাটাতন ছিল অর্থাৎ ঘরের অর্ধেকে ফ্রেমড কাঠ দিয়ে দুই ফিট উচুতে মেঝে করা ছিল যেখানে ঘুমানোর ব্যবস্থা। উপরে কাঠের সিলিং, যে কারণে দেড় তলা। আমরা যে রুমে থাকতাম তার পশ্চিম জানালায় খাটে পা’ঝুলিয়ে আমি একা বসে থাকতাম আর কিযে ভাবতাম কে জানে। বর্ষা কালের মজা ছিল নৌকা চড়া, নৌকায় স্কুলে যাওয়া। গ্রামের উত্তরে বড় হাওর, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে উত্তর দিকে তাকালে চোখে পড়ত মেঘালয়ের পাহাড়, কোন কোন পরিস্কার দিনে পাহাড়ের ঝর্না পর্যন্ত দেখা যেত। আর ছিল মাছ, মাছের মেলা আর মেলা মাছ। প্রায় প্রতি মাসেই মাছ আর মাছ ধরার পদ্ধতি বদলাতো। বিশেষ করে বর্ষার শুরুতে “চেপ-চেইপ্যা” পানিতে ‘হলংগা’ টানা,বর্ষায় রাত্রি বেলা নোউকার গলুইয়ে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে ‘আওলা মারা’ আর শ্রাবন-ভাদ্র মাসের বাতাসবিহীন দিন গুলোতে ‘নিরাই মারা’র কথা খুব মনে পড়ে। শীতকালের মজা ছিল বিভিন্ন ওরসের মেলা, এর কিছুদিন পরেই হিন্দু পরবের ‘বান্নি’, বান্নি গুলো মূলতঃ বারুনী স্নান উপলক্ষে বসা মেলা। চৈত্র সংক্রান্তী’র মেলা ও ছিল। আমরা মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে দল বেধে বিভিন্ন বান্নি বা মেলায় যেতাম। পৌষ মাসে বুলা বাজারের শাহ বায়েজিদ এর মেলা আর করাব ইউনিয়নে বেলেশ্বরী বান্নি ছিল কমন, কারণ এ দুটোতে পরেও অনেক বার গিয়েছি।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল “বড়বাড়ি’র” পুকুরে সাঁতার শিখা। আম্মার সঙ্গে গোসল করতে যেতাম সেখানে আর আম্মা আমাকে সাঁতার শিখানোর চেষ্টা করলেন। চেষ্টা সহয, কিছুক্ষন তালিম দেবার পর ধাক্কা দিয়ে গভীর পানিতে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সাঁতার না শিখে আর উপায় ছিল না। এর নেট লাভ ছিল এরপর থেকে সুতাং নদীতে দীর্ঘ সময় কাটানো আর বর্ষায় স্কুলে যাবার ভীতি কাটানো।
পরের বছরে, ১৯৬৯ সালে হবিগঞ্জ মহকুমা শহরে টাউন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হই। তখন আমাদের বাসা কোর্ট স্টেশন রোডে। হেড মাস্টার ছিলেন আবদুল মতিন স্যার। স্যার এর বাড়ি ছিল গোবিন্দপুর, শহরের পূর্ব দিকে, নদীর ওপারে। স্যারের ভাই এর ছেলে আশিক আমাদের ক্লাশেই পড়তো। তার সঙ্গে গোবিন্দপুর বেড়াতেও গিয়েছি। আমার আর এক ক্লাশ মেট ছিল মতিউর, তার বাবা ছিল পিডাব্লিউডি এর এসডিই, তাঁদের বাসা ছিল স্কুলের কাছেই। তার বাসায় অনেকবারই গিয়েছি এবং তার বাসা থেকেই সেবা প্রকাশনীর কুয়াশা’র সঙ্গে পরিচয়! মতিউর এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হয়েছিল, এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। আমার বড় বোনও একই ক্লাশে পড়তো কিন্তু পঞ্চম শ্রেণীর পর আপা বাসন্তীকুমারী গোপালচন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেও হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে সিট ছিল না। ফলে আমার অপসন ছিল জেকে এন্ড এইচকে স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া বা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া। আমি দ্বিতীয়টিই বেছে নিলাম। এতে আমার ক্ষতি হয়নি কারণ এর আগে ১৯৬৭ সালে আমি প্রথম ৬ মাস চট্টগ্রামে দ্বিতীয় শ্রেণী এবং দ্বিতীয় ৬ মাস ঢাকায় তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েছিলাম। ফলে বাস্তবে আমার কোন শিক্ষা বৎসর এর ক্ষতি হয় নাই। ১৯৬৯ সালে মহকুমা শহরে আসার পর থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের স্পর্শ করতে শুরু করে। গণআন্দোলন তখন দানা বেঁধে উঠছে, বঙ্গবন্ধু তখনো বঙ্গবন্ধু হন নাই, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেলবন্দী। সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাল, তখনই জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো শ্লোগানে স্কুল থেকে বহু মিছিলে যোগ দিয়েছি। কলেজ-উচ্চ বিদ্যালয় এর বড় ভাইয়েরা এসে আমাদের স্কুল থেকে বের করে মিছিলে নিয়ে যেত। ছুটির পর বিকেলে মিছিল দেখেও তার মাঝে ঢুকে যেতাম। আব্বা প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি করায় বাসায় ও এর পরিবেশ ছিল। বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হলেন, আইয়ুব খানের পতন ঘটলো, আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এলেন ক্ষমতায়। এরকম সময়ে আমাদের স্কুল এর ছাত্রদের সঙ্গে এক অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে গেল। হবিগঞ্জ নিউ ফিল্ড আমাদের সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় এর মাঠ। মাঠ এর পাশেই, কলেজ এর পশ্চিমে আনসার এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তারা আমাদের মাঠ ব্যবহার করতো। একদিন বিকেলে আমাদের স্কুলের ছাত্ররা গিয়েছে হকি খেলতে, তখনকার সময়ে স্কুলের ফুল হকি সেট ছিল এবং খেলাও হত, আনসারদের প্রশিক্ষণও চলছিল। সেখানে বল গিয়ে আঘাত করা বা এমন কিছু নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়, ছাত্রদের মারধোর করে, তারা দৌঁড়ে কলেজের দিকে আসে, এরপর কলেজের ছাত্ররা সহ হামলা করে পুরো শীতকালীন আনসার ক্যাম্প আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়, ট্রেনিং এর ডামি রাইফেল লুট হয়। সামরিক শাসনের মধ্যে এই ঘটনা। আমাদের স্কুলের তিন শিক্ষক আবদুল আলীম স্যার (বাসা ছিল মুসলিম কোয়ার্টার), আবদুল মালিক চৌধুরী স্যার (বাসা পুরান মুন্সেফী) আর নোয়াখালী নিবাসী স্পোর্টস টিচার নুর নবী স্যার সহ অনেককে আসামী করে মামলা হয়। তিন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন আলীম-মালিক-নবী স্যার এর মুক্তি চাই বলেও মিছিল করেছি।