বিনা সুদে ঋণ প্রদানের দাবি
মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে নি¤œ আয়ের মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। দেশে ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন দলিত সম্প্রদায়ের লোকেরা। লকডাউনের কারণে কর্ম হারিয়ে তাদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। সংকটকালীন সময়ে দলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিনা সুদে ঋণ প্রদানের দাবি ভুক্তভোগীদের।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ শহরের রাজনগর রবিদাশ পাড়ার নারায়ন রবিদাশ জানান- করোনা ভাইরাসের কারণে সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করলে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েন দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন। হঠাৎ করেই উপার্জন বন্ধ হয়ে যায় তাদের। ফলে আর্থিকভাবে তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েন। তাদের পাড়ায় প্রায় ২০টি রবিদাস পরিবারের বসবাস। বংশ পরম্পরায় তাঁরা এখানে বাস করে আসছেন। পাড়ার বাসিন্দারা জুতা তৈরীর সাথে জড়িত থাকলেও এ পেশায় দুর্দিনের কারণে অনেকে এ পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। যারা এ পেশায় রয়েগেছেন তাঁরা এ পেশা থেকে অর্জিত আয়ে কোন রকম জীবণ ধারণ করে থাকেন। তিনি জানান, করোনার কারণে যখন সরকার লকডাউন ঘোষণা করেন তখন তাঁরা কাজের জন্য হাট-বাজারে যেতে পারেননি। বাড়িতে বসে তাঁরা অলস সময় পার করেছেন। তবে লকডাউনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে তারা চাল, ডাল, লবণ, তৈল, সাবান, আলুসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন। পাড়ার সকলেই কম-বেশি সহায়তা পেয়েছেন। ফলে তাঁরা সন্তান-সন্ততি নিয়ে কোন রকমে জীবন ধারণ করেছেন। বর্তমানে সীমিত পরিসরে সব কিছু শুরু হলেও তাদের হাতে তেমন কোন কাজ নেই। হাট-বাজারে লোক সমাগম কম থাকায় মানুষ জুতো মেরামত করতে তেমন একটা বাজারে আসে না। যারা জুতো মেরামতের কাজ করে থাকেন তাঁরা দিনশেষে ১০০/১৫০ টাকার বেশি রোজগার করতে পারছেন না। তাছাড়া সবকিছু সীমিত পরিসরে চলাচল থাকায় বাজারে তরি তরকারিসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও বেশি। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন ধারণে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
তিনি আরও জানান- দলিত সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সরাসরি সরকারি আর্থিক প্রণোদনার আওতায় নেই। আবার তারা শ্রম আইনের বাইরে থাকায় পেনশন কিংবা ন্যুনতম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগও তাদের নেই। যদিও আপদকালীন সময়ে তারা সরকারের পক্ষ থেকে যৎসামান্য চাল-ডাল পেয়েছেন। কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। তবে সংকটকালীন সময়ে তা তাদের বিরাট উপকারে এসেছে বলেও জানান তিনি। এই সংকটকালীন সময়ে দলিত সম্প্রদায়কে রক্ষায় সরকারের খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা প্রদানেরও দাবি জানান।
একই পাড়ার রীতা রবিদাশ জানান, তাদের পাড়ায় প্রায় ২০টি পরিবারের বসবাস। পূর্ব পুরুষ থেকে তারা চামড়াজাত পণ্য তৈরির সাথে জড়িত। তবে বর্তমানে এ পেশায় ৫/৬টি পরিবার জড়িত আছে। অভাবের তাড়নায় অনেকেই এ পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় চলে গেছে। করোনাকালে দুর্ভোগ যেন তাদের তাড়া করতে আসে। প্রথমে পৌরসভা হতে ২ বার বিনামূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। পরে আরও ২ বার ১০ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। জেলা প্রশাসক নিজে এসে তাদের চাল, ডাল, আলুসহ অন্যান্য উপকরণ দিয়েছেন। এতে প্রাথমিকভাবে তারা অনেকটা উপকৃত হন। কিন্তু করোনার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় তাদের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তিনি জানান- পাড়ার বসবাসকারী অধিকাংশই বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন। কারও সাপ্তাহিক কারও মাসিক কিস্তি রয়েছে। করোনা চলাকালে ২ মাস কিস্তি নেয়া বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে কিস্তি পরিশোধের জন্য এনজিও সংস্থার লোকজন তাদের চাপ প্রয়োগ করে। ফলে তারা নিরূপায় হয়ে কিস্তি পরিশোধ করতে পুনরায় ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে ক্রমেই তারা ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছেন। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে যেয়ে তারা করোনার চেয়েও বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত ২ হাজার ৫শ’ টাকা পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান- বিষয়টি তার জানা নেই।
রীতা রবিদাশ আক্ষেপ করে বলেন- একদিকে পেটে ক্ষুধার জ্বালা, অন্যদিকে ঋণের জ্বালা। তার উপর নতুন করে আরেক দুঃশ্চিন্তা মাথায় এসে চেপেছে। তিনি বলেন তার দুই সন্তান লেখাপড়া করছে। এক মেয়ে সরকারি মহিলা কলেজে বিএ ক্লাসে লেখাপড়া করে। আর এক ছেলে হবিগঞ্জ হাই স্কুল এন্ড কলেজে ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। ছেলে এবার জেএসসি পরীক্ষার্থী। করোনার কারণে স্কুল কলেজ বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে অনলাইনে ক্লাস চলছে। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে ছেলে মেয়ের অনলাইন ক্লাস করতে কম্পিউটার বা অ্যানড্রয়েট মোবাইল ফোন কিনে দেয়া কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাভাবে ছেলেকে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন কিনে দিতে পারছেন না। সামনে ছেলের জেএসসি পরীক্ষায় তাই তিনি খুব টেনশনে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি সরকারি সহযোগিতা কামনা করেন।
হবিগঞ্জ জেলা সেলুন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রথীন্দ্র কুমার চন্দ বলেন- ২০ বছর ধরে আমি সেলুন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। কিন্তু আমি কখনো চিন্তা করতে পারিনি করোনার কারণে আমাদের জীবনে এমন দুর্যোগ নেমে আসবে। তিনি দাবি করেন সেলুন ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত নি¤œ বর্ণের। যার যারা কারিগর অর্থাৎ নরসুন্দর তাদের অবস্থা এমন পর্যাযে যে, দিন শেষে যা উপার্জন হবে রাতে বাড়ি ফেরার সময় তা দিয়ে তারা পরিবারের জন্য খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে নেবে। কিন্তু করোনা তাদের জীবন জীবিকায় মারাত্বক প্রভাব ফেলেছে। কর্ম হারিয়ে তারা দুর্বিসহ জীবন পার করছেন। তাদের অন্যকোন আয়ের উৎস না থাকায় এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে আনা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে তারা এখন দিশেহারা। অনেকেই কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে দোকান ভাড়া দিতে না পেরে আরও ঋণগ্রস্থ হচ্ছেন। সংসার চালাতে না পেরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তিনি জানান- গত ২৫ মার্চ থেকে ২০ মে পর্যন্ত হবিগঞ্জের সকল সেলুন পুরোপুরি বন্ধ থাকে। মধ্যে কয়েকদিন সীমিত পরিসরে খোলা হলেও আজমিরীগঞ্জে কয়েকজন নরসুন্দরের করোনা পজেটিভ হওয়ায় তখন আবারও হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, বানিয়াচং এবং আজমিরীগঞ্জসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুনরায় ১৫ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়। ফলে সংকট আরও ঘণিভূত হয়। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেলুন খোলা হলেও করোনার প্রভা এখনো রয়েছে। মানুষের ধারণা সেলুনে যারা কাজ করেন তাদের সংস্পর্শে গেলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অনেকেই এখনো সেলুনে আসতে চান না।
করোনাকালীন সময়ে কোন সহায়তা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান- হবিগঞ্জ শহরের ২শ’ সেলুন সমিতির অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এছাড়াও পৌরসভার ভিতরে শতাধিক সেলুন রয়েছে যারা সমিতির অন্তর্ভূক্ত নয়। গড়ে প্রতিটি সেলুনে ৪ জন করে কারিগর (নরসুন্দর) রয়েছেন। আর তাদের আয়ের উপর নির্ভর পরিবার পরিজন। করোনার কারণে কর্ম হারিয়ে এসব পরিবার মানবিক সংকটে পড়ে। যদিও সমিরি পক্ষ থেকে সকল স্থরে যোগাযোগ করে তাদের দুর্ভোগ লাঘব করার চেষ্টা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান তাদের সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। করোনার কারণে দোকান বন্ধ থাকলেও ব্যবসায়ীদেরকে দোকান ভাড়া ঠিকই দিতে হয়েছে। ফলে সেলুন ব্যবসায়ীরা আরও বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন। তিনি সংকট মোকাবেলায় প্রতিটি সেলুন তালিকাভূক্ত করে বিনা সুদে অথবা স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তিনি বিশ্বাস করেন এতে দুর্ভোগ অনেক লাঘব হবে। নতুবা মানবিক সংকটে পড়বে এ খাতে সংশ্লিষ্টরা।