আজ পহেলা মহররম। ১৪৪২ হিজরী। মহররম মানে পবিত্র। কিন্তু মাহে মহররম হলো কারবালার মাস। আহলে বাইতকে নিঃশেষ করে দেবার এক ভয়ংকর এবং নির্মম ভয়াবহ অধ্যায়ের মাস। একদিকে এ মাসের মাধ্যমে হিজরী বছরের শুরু। অন্যদিকে কারবালার শোকাবহ ঘটনার কারণে এ মাস কষ্টের, শোকের মাস এবং কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হবার মাস।
সূরা তওবার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।” এ চারটি পবিত্র মাস হলো: জিলক্বদ, জিলহজ্ব, মহররম এবং রজব। এ মাসগুলোতে হত্যা, হানাহানি, অন্য মানুষের উপর অন্যায় অত্যাচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এই মাসেই কারবালায় একদল নামধারী, লেবাসী, নামাযী নরাধমের হাতে বেহেশ্তের সরদার, আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরা এবং নয়নমণি ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে ৭২ জন সঙ্গীসাথী সহ নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। আহলে বাইত এবং আলে রাসূল (দরূদ) এর পরিবারের মহিলাদের বেপর্দা করে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেস্কে নরাধম এজিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কাজেই মহররম পুরোটাই শোকের, কষ্টের এবং আহলে বাইতের জন্যে সত্যিকার অর্থেই বালা ও মুসিবতের মাস।
অপরদিকে এ মাসটি সৃষ্টির শুরু থেকেই পবিত্র মাস হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এ মাসের মধ্যেই রয়েছে আশুরা দিবস। আশুরা মানে দশম। ইসলামী পরিভাষায় ‘আশুরা’ হলো হিজরী সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিন। ৬১ হিজরীর এই দিনেই কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাও সংঘটিত হয়। তবে আশুরা অন্য অনেক কারণেও মুসলমান, ইহুদী এবং খৃষ্টানদের কাছে তাৎপর্যবহ। এই দিনেই আল্লাহ্পাক হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। এই দিনেই তিনি ইন্তিকাল করেন। সেদিনও ছিল শুক্রবার। ফলে শুক্রবারকে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য পবিত্র ঈদের দিন হিসেবে দান করা হয়। অবাক করার ব্যাপার হলো কারবালার ঘটনা যেদিন ঘটে সেদিনও ছিল শুক্রবার। আর এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। ফলে এই দিনে অর্থাৎ শুক্রবারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম তাঁর উপর বেশি বেশি দুরূদ পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন।
খলিফা উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে ১৬ হিজরীতে হিজরী সাল গণনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর পূর্বে মুসলমানদের নিজস্ব কোনও দিনপঞ্জি ছিল না। রোমানদের ছিল গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জি যা আমরা বর্তমানে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করি (ইংরেজি সন হিসেবে যা পরিচিত) আর পারস্যবাসীদের ছিল নিজস্ব দিনপঞ্জি। যা তাদের নবী যারোস্টার বা যারাথ্রস্টের সময় থেকে গণনা করা হতো। মুসলমানদের নিজস্ব দিনপঞ্জি না থাকায় ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন সরকারি কাজকর্মে এবং চিঠি আদানপ্রদানে সমস্যা হচ্ছিল। কুফার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলিফা উমর (রা) কে চিঠি লিখে এ সমস্যার সমাধান প্রার্থনা করেন। খলিফা উমর খেলাফতের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সভার আয়োজন করেন। এতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রস্তাব পেশ করেন। তবে সর্বসম্মতিক্রমে মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর পরামর্শে হিজরতের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পহেলা মহররম থেকে মুসলমানদের নিজস্ব সন গণনার প্রস্তাব গৃহীত হয়। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে হিজরতের ব্যাপারে ইংগিত দিলে তিনি মহররমের এক তারিখে দুটো উট খরিদ করে আনেন। এর একটি হলো কাসওয়া যা রাসূল (দরূদ) এর নিত্য সাথী ছিল।
একাধিক হাদিসে এসেছে, রাসূল (দরূদ) রমজানের পর মহররম মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার এবং অন্যান্য আমলের ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। উল্লেখ্য, বেশ কিছু হাদিসে পাওয়া যায়, রমজানের পর তিনি শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। তবে মহররম মাসের ব্যাপারে জীবনের শেষের দিকে এসে তিনি রোজা এবং অন্যান্য আমলের উপর গুরুত্ব দেন। আশুরার রোজার বিখ্যাত হাদিসটি দশম হিজরী সালের। এটাই ছিল রাসূল (দরূদ) এর জীীবনের শেষ আশুরা।
মহররম মাসকে আল্লাহ পাকের মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে একটি হাদিসে। এ মাস আল্লাহর মাস হবার পেছনে বেশ রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহী ওয়াসাল্লাম বলেন, রমযান মাসের পর রোযা রাখার সর্বোত্তম মাস হলো আল্লাহর মাস মহররম আর ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হলো রাত্রিকালীন নামায। [মুসলিম – ২৮১২]
আল্লাহ পাক এ মাসে আমাদের বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুন, আমীন। অন্তত আশুরা উপলক্ষে আমরা যেন দুটো রোজা রাখি। নবম এবং দশম মহররম কিংবা দশম এবং একাদশ মহররম।