আদালতে গ্রেফতারকৃত জাকির হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

এসএম সুরুজ আলী ॥ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি এলাকায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা থেকে ফেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী মদিনাতুল কোবরা জেরিনকে হত্যা করা হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যা নয়, সিদ্ধান্ত ছিল অপহরণের। কিন্তু স্কুলের কাছে সিএনজি অটোরিক্সা পৌঁছা মাত্রই পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটে। অটোরিকশায় শ্লীলতাহানীর চেষ্টা চালায় জাকির হোসেন। এ সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে গাড়ি থেকে লাফ দিতে চায় ওই ছাত্রী। অবস্থা বেগতিক দেখে জাকির ও তার সহযোগি হৃদয় মিয়া জেরিনকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে সে গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯ জানুয়ারি মারা যায় মদিনাতুল কোবরা জেরিন। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানিয়েছে গ্রেফতারকৃত জাকির হোসেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান উদ্দিন প্রধানের আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
তার স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে মঙ্গলবার রাতে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম)। তিনি বলেন, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আব্দুল হাই কন্যা মদিনাতুল কুবরা প্রকাশ জেরিন (১৬) রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। সে ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী। সে সুশ্রী ও মেধাবী ছাত্রী ছিল। ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তিও পেয়েছিল জেরিন। এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষে গত প্রায় ২ মাস ধরে স্কুলে সকাল ৮টার দিকে কোচিং ক্লাসে যাওয়া আসা করে। তার বাড়ি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে রিচি উচ্চ বিদ্যালয় হওয়ায় সে বাড়ির নিকট ধল তেমুনিয়া পয়েন্ট থেকে ফোর স্টোক সিএনজি দিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া করে। ৪/৫ বছর আগে নিহত জেরিনের প্রতি কুনজর পড়ে একই গ্রামের মোঃ দিদার হোসেনের ছেলে মোঃ জাকির হোসেন (২৫) এর। সে বিভিন্ন সময় জেরিনকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু জেরিন তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। গত প্রায় ১ মাস পূর্বে জেরিনকে রাস্তায় পেয়ে জাকির হোসেন পুনরায় প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এতে জেরিন রাগান্বিত হয়ে তার প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় জাকির হোসেন তাকে গালিগালাজ করে। বিষয়টি জেরিন তার মা-বাবাকে জানায়। জেরিনের বাবা জাকিরের পরিবারকে এ বিষয়টি জানালে জাকিরের বাবা ও বড় ভাই জেরিনের বাড়িতে এসে পরবর্তীতে জাকির হোসেন তাকে আর ডিস্টার্ব করবে না বলে আশ^স্থ করেন। এদিকে পরিবারের কাছে বিচার দেয়ায় জেরিনের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে জাকির। সে জেরিনকে অপহরণ করে হত্যার পরিকল্পনা করে। এক পর্যায়ে জাকির সহপাঠি পাটলি গ্রামের সিএনজি চালক নুর আলম (২০) ও তার বন্ধু হৃদয়কে (২০) নিয়ে জেরিনকে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ১৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বাড়ির পাশে লাখাই-হবিগঞ্জ সড়কের তেমুনিয়া পয়েন্টে অবস্থান নেয় তারা। এ সময় জাকির হোসেন একই রাস্তায় সামান্য দূরে অবস্থান নেয়। জেরিন প্রতিদিনের ন্যায় স্কুলে যাওয়ার জন্য তেমুনিয়া পয়েন্টে গেলে নুর আলমের সিএনজি গাড়ীতে উঠে। চালক নুর আলম গাড়ীতে থাকা তার বন্ধু হৃদয়কে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সামান্য দূরে পথিমধ্যে পূর্ব থেকে অবস্থান নেওয়া জাকির হোসেনকে গাড়ীতে তোলে নুর আলম। সিএনজি গাড়ীটি রিচি স্কুলের প্রথম গেইট ও ২য় গেইটে না থামালে জেরিন বুঝতে পারে জাকির গং তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় গাড়ীতে থাকা জাকির ও তার বন্ধু হৃদয় জেরিনের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। জেরিন নিজেকে রক্ষার জন্য শোর চিৎকার করে গাড়ী থেকে লাফ দিয়ে পড়ার চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে জাকির ও তার সহযোগী হৃদয় মিয়া জেরিনকে ধাক্কা দিয়ে সিএনজি থেকে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে জেরিন গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থায় স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাকে প্রথমে হবিগঞ্জ সদর ও পরবর্তীতে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। মাথায় জখমের কারনে জেরিন ঠিকমতো কথা বলতে পারেনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার পরদিন ১৯ জানুয়ারি সকাল ৯টায় ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় জেরিন। পরে জেরিন সিএনজি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে বলে এলাকায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ ও সড়ক অবরোধ করে। সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষনিক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) রবিউল ইসলাম পিপিএম, সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলীসহ পুলিশের একটি টিম রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের এ ঘটনায় দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের আশ^াস দেন। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এদিকে জেরিনের মৃত্যুর ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে সিএনজি গাড়ী থেকে পড়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বলে ছড়িয়ে পড়ায় জেরিনের পরিবারও মৃতদেহ ময়না তদন্ত ছাড়া পুলিশকে না জানিয়ে বাড়িতে এনে দাফন করে। তবে পুলিশ বিষয়টি নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখে ঘটনার পেছনে আরো ঘটনা জানতে পারে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, এ প্রেক্ষিতে তার নির্দেশনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম পিপিএম, হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী, পুলিশ পরিদর্শক দৌস মোহাম্মদ, পুলিশ পরিদর্শক গোলাম কিবরিয়া হাসান, এসআই সাহিদ মিয়া, এসআই পলাশ চন্দ্র দাসসহ পুলিশের দুইটি টিম মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের জন্য প্রকাশ্যে ও গোপনে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। তদন্তকালে সিএনজি গাড়ীটি সনাক্ত করে অপহরণে ব্যবহৃত সিএনজি (হবিগঞ্জ থ-১১-৩২২৫) ২০ জানুয়ারি পলাতক আসামী নুর আলমের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। সিএনজি অটোরিক্সাটি উদ্ধারের পর জেরিনের বাবা আব্দুল হাই ২০ জানুয়ারি রাতে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে তার মেয়েকে অপহরণ ও খুনের দায়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে নিহত জেরিনকে একই গ্রামের দিদার হোসেনের ছেলে জাকির হোসেন (২৫) বিভিন্ন সময়ে প্রেমের প্রস্তাব দিত। জেরিন তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এবং তার পরিবারে বিচার দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারি সকাল ৯টায় তার বন্ধু সিএনজি চালক নুর আলম ও হৃদয়কে নিয়ে জেরিন আক্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করে জাকির। অপহরণে ব্যর্থ হয়ে রিচি স্কুলের সামনে চলন্ত গাড়ী থেকে ধস্তাধস্তি অথবা কোন ভাবে ধাক্কার কারনে জেরিন পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। ঘটনার পর থেকে জাকির হোসেন নিজেকে আড়াল করে রাখে। তার চলাফেরা ও গতিবিধি গভীর পর্যবেক্ষনে রাখে পুলিশ। পরবর্তীতে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে ঘটনার আগে ও পরে তার সহযোগী সিএনজি চালক নুর আলমের সাথে বারবার যোগাযোগ হয়েছে নিশ্চিত হয় পুলিশ। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে ওসি মোঃ মাসুক আলী অন্যান্য অফিসার ও ফোর্সের সমন্বয়ে পুলিশের একটি টিম তৈরি করে ২০ জানুয়ারি রাত পৌনে ১২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ধল এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত জাকির হোসেনকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে নিহত জেরিনের সাথে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রতিশোধ হিসেবে তার সহযোগী নুর আলম ও হৃদয়কে নিয়ে কৌশলে জেরিনকে অপহরণ করার কথা স্বীকার করে। সে জানায়, জেরিন স্কুল এলাকা পার হয়ে যাওয়ার পর চলন্তÍ গাড়ী থেকে নেমে যাওয়া চেষ্টা চালায়। এ সময় তার সহযোগী জাকির ও হৃদয়ের ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাদের ধাক্কার কারনে জেরিন রাস্তায় পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। গতকাল মঙ্গলবার জাকির হোসেনকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। জাকির হোসেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সুলতান উদ্দিন প্রধানের কাছে দোষ স্বীকার করে সহযোগীদের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জোর পুলিশি তৎপরতা ও তদন্ত কার্যক্রমের কারনে ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে এবং আসামীকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। জনমনে পুলিশের উপর আরো আস্থা সৃষ্টি হবে বলে পুলিশ সুপার বিশ^াস করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম (পিপিএম), হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী, পুলিশ পরিদর্শক দৌস মোহাম্মদ।