
ডা. মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব
স্ত্রীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা তথা বড় কুটুমের পরিকল্পনা মাফিক ভারত সফরে এসে পর্যায়ক্রমে দিল্লী, আগ্রা হয়ে জয়পুর যাওয়ার পথে রেল-বিমান সংযোগের সুবিধার্থে অর্থাৎ যোগাযোগের বেড়াজালে আজমীরে দু’রাত অবস্থান হয়ে পড়ল অবশ্যম্ভাবী। ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে যে মহান সাধক ইতিহাস রচনা করে গেছেন, জীবদ্দশায় যার অনেক অলৌকিক গুণাবলী, সাদাসিধে চালচলন ও নুরানি চেহারার বদৌলতে ইসলাম প্রচারে ত্বড়িৎ প্রসারতা লাভ করেছিল তিনি হলেন সুলতানে হিন্দ মহান সুফী সাধক জনাব খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রঃ)। তিনি পারস্যের খোরাসান প্রদেশের সিস্তান রাজ্যের সান্জার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করতঃ বোখারার নিশায় ইসলামের উপর অগাধ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। অতঃপর বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) ও উনার পীর শিক্ষগুরু ওসমান হারুনীর (রঃ) নির্দেশে তৎকালীন অবিচার, অত্যাচার, পাপাচার কবলিত হিন্দুস্থানে ধর্ম প্রচার উপলক্ষে আগমন করেন আজ থেকে প্রায় সাতশত বছর পূর্বে। তখনকার আজমীরের ডাকসাইটে রাজা পৃত্থিরাজকে দিল্লীর কুতুব উদ্দিন আইবেকের সহায়তায় পরাজিত করেন যার সাথে অনেক অলৌকিক ঘটনার বিবরণ কথিত আছে আজো মুখে মুখে।
সুতরাং সফরসঙ্গী আমার সহধর্মিনী, তার জৈষ্ঠ্য ভ্রাতা আমেরিকা প্রবাসী ডা. মামুন সাহেব, কনিষ্ঠ ভ্রাতা যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যারিস্টার মাহমুদ (মাসুম) ও ছোট ভাই অ্যাডভোকেট মোর্শেদসহ সুলতানে হিন্দ খাজা মঈন উদ্দিন চিশতির (রঃ) মাজারে সালাম দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম স্বাভাবিক কারণেই।
রাত প্রায় পৌনে বারটা। লোক সমাগম তুলনামূলকভাবে কম। মাজারের ১নং গেইট দিয়ে প্রবেশ পথে পাথরের ধাপ তথা কয়েকটা সিঁড়ি। যেখান থেকে মাজার কয়েকশ’ গজ দূরে। আমেরিকান প্রবাসী ডা. মামুন সাহেব যিনি সর্বোতই পীর মাশায়েকদের প্রতি অনেকটা দুর্বল, প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই প্রৌঢ় বয়সী এক খাদেম সাহেব, উচ্চস্বরে অপ্রকাশযোগ্য যে অশোভন আচরণ সমেত এগিয়ে আসলেন জুতা নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখার কারণে আমরা হতভম্ব। উনি জুতা খোলার উদ্দেশ্যই পা’টা সিঁড়িতে রেখেছিলেন। খুলতে দেরি হওয়ার কারণে দুইজন খাদেম সাহেব ভীষণ চটে গেলেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, ভাই আমরা মুসলমান, আপনাদের মেহমান হিসেবে অনেক দূর থেকে এসেছি এবং জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে এসেছি। খাদেম সাহেবেরা দুই-তিনজন এক হয়ে গেলেন। হিন্দিতে একজন যা বললেন অর্থ হল ‘মুসলমান কি? আমরা জাতে সৈয়দ, আমরা আপনাদের মুসলমান বানিয়েছি, এটা আমাদের রাজত্ব, এখানে আমাদের আদেশ চলবে।’ ডা. মামুন সাহেব পরিচয় দিলেন, উনি একজন ডাক্তার আমেরিকা থেকে এসেছেন, উনার ছোট ভাই একজন ব্যারিস্টার ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন। আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘উনিও একজন বড় ডাক্তার’। কে শুনে কার কথা। ইতোমধ্যে অনেক লোক সমবেত হয়ে গেল। বাহিরে উপবিষ্ট দায়িত্বশীল একজন সমজদার পুলিশ এগিয়ে এলেন। আমি বললাম ভাই এখানে এহেন আচরণ কেন? উনার হিন্দি বক্তব্যের মর্মার্থ হলো এই- ‘ভাই ওরা এরকমই, এখানে খুব একটা কিছু করার নেই’। এরই মধ্যে নজরে পড়ল, এক সুশ্রী টুপি পাঞ্জাবী পরিহিত যুবক সিঁড়িতে ঝুকে মাজারকে উপলক্ষ করে তিনটা সেজদা দিয়ে চলে গেল।
গেইটের বাহিরে পঞ্চ জুতাযুগল টোকেনের বিনিময়ে রেখে মাজারের দিকে আমরা পাঁচজন এগুতে থাকলাম। পথিমধ্যে ডানদিকে উনাদের আস্তানায় নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। বুঝতে বাকি রইল না আমাদের নিকট থেকে মাজারের নামে কিছু পাউন্ড, ডলার, রুপি খসানো যায় কি-না। আমার ইশারায় সবাই এ বাঁধা অতিক্রম করলাম কোনভাবে।
মাজারের কাছে এসে মনটা আরো খারাপ এবং ক্ষিপ্ত হয়ে গেল যখন নজরে পড়ল সাদামাটা লোকজন টাকার থালা নিয়ে বসা এক অজাতশত্রু খাদেমের পাশেই একের পর এক মাজারকে উপলক্ষ করে সেজদা দিতেছিলেন পালাক্রমে, আর তাদের কষ্টোপার্জিত টাকা খাদেমের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন অবলীলায়। মাজার কোঠার মূল ফটক মোটা তালাবদ্ধ করে রাখা। জানতে পারলাম মোটা অংকের টাকা বা শিন্নি প্রদান করা হলে তালা খুলে দেয়া হয় ভিতরে প্রবেশ করে জিয়ারত করার জন্যে।
ফিরে আসার সময় নাছোরবান্দা ঐ খাদেমগণ গেইট পর্যন্ত পিছু পিছু আমাদেরকে ডলার, পাউন্ড, রুপি দেয়ার জন্য বিরবির করতে ছিলেন। অবশেষে না পেয়ে তিরষ্কারমূলক কি যেন বলতে ছিলেন। শুনেও না শুনার ভান করে নিজের সম্মান রক্ষা করে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সকলে হোটেলে চলে আসলাম।
শুধু এই ভাবছিলাম, এখানে শুয়ে থাকা সুলতানে হিন্দ গরীবে নেওয়াজ মহাজ্ঞানী সুফি সাধক যিনি সুদূর পারস্য থেকে এসে নিজ অমায়িক যাদুকরী ব্যবহার ও অনিন্দ সুন্দর জ্যোতির্ময় চেহারার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে এনেছিলেন, যিনি অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, একাধারে সাতদিন খেয়ে না খেয়ে রোজা রাখতেন, ধনদৌলত টাকা-পয়সার প্রতি যার সামান্যতম মোহ ছিল না আজ উনাকেই ব্যবহার করে কতিপয় অনুসারী টাকা-পয়সার লোভে সহজ সরল মানুষদের বিভ্রান্ত করছেন। যিনি আল্লাহর অংশীদারিত্ব তথা শিরকের বিরুদ্ধে তলোয়ার সমৃদ্ধ হাজারো ভক্তের নেতৃত্ব দিয়েছেন আজ উনারই সমাধিস্থলকে শিরকের আস্তানা বানিয়ে ফায়দা লুটা হচ্ছে।
সত্যি এহেন এ করুণ অবস্থা আমাদেরকে দারুণ পীড়া দিচ্ছিল বৈ কি।
শুধু পরম করুণাময়ের নিকট এটুকু আবেদন, হে মহান পথ প্রদর্শক, ইসলামের এ দুর্যোগপূর্ণ মূহুর্তে আমাদের সকলকে সঠিক হেদায়েত প্রদান করুন। আমিন।