ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
১৯৮২ সাল, মেডিকেলের শেষ বর্ষের পড়াশোনার চাপ তুঙ্গে। ভোরে দখিনের জানালা খুলে পড়তে বসেছি সারাটাদিন একনাগাড়ে পড়ব মনে করে। পরীক্ষা নিকটবর্তী বিধায় মনযোগ যারপরনাই।
হঠাৎ দরজায় টক্ টক্ শব্দ। খুলে দেখি আমার প্রাইমারির ক্লাস ফাইভের শ্রেণী শিক্ষক আমার অত্যন্ত প্রিয় উপেন্দ্র স্যার। চোখে মুখে কেমন জানি একটা বিষন্নতার ছাপ। কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে স্যারকে বসতে দিয়ে এক গ্লাস পানি দিলাম। না, ঢক ঢক করে প্রায় দু’গ্লাস পানি খেলেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দু’তিন মিনিট পর জিজ্ঞেস করলাম স্যার কিছু হয়েছে? ডাক্তার দেখানোর জন্য গ্রাম থেকে এক গরীব রোগীকে নিয়ে এসে সন্ধ্যায় কাষ্টঘর এক হোটেলে উঠেছিলেন। রোগীর সিগারেটের আগুন থেকে রুমে আগুন লেগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে কি করতে হবে তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
মাসের শেষ, আমার হাতের টাকা কড়িও শেষের পথে। এ সময়টাতে প্রায় সকলের অবস্থাই তথৈবচ। নিজের থেকে কিছুসহ রুমমেটদের কাছ থেকে বাকিটা ধার করে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে আবুলের দোকানে স্যার সহ প্রাতরাশ সম্পন্ন করে হোটেলের ঝামেলা শেষ করে দিয়ে আসলাম। বিকেলে রোগীর চিকিৎসা পর্ব সহ সারাটাদিন ব্যস্ততায়ই কেটে গেল। সন্ধ্যায় বাসে উঠিয়ে দিয়ে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে গেল। ফেরার পথে খরচের জন্য আরো দু’শ টাকা স্যারের হাতে গুজে দিলাম। স্যার ফ্যাল ফ্যাল করে সজল চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হোস্টেলে ফেরার পথে ভাবছিলাম, এইতো আমার সেই উপেন্দ্র স্যার যিনি প্রাইমারিতে আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তানের মত প্রায়শই আদর করতেন। ক্লাস টু’তে পড়াকালীন একসময় সেই উপেন্দ্র স্যার সদলবলে অসুস্থ আমাকে বাড়িতে দেখতে এসেছিলেন। প্রাইমারির শেষ পরীক্ষার পর আমাদের ক্লাসের সকলকে বাড়িতে নেমন্তন্ন দিয়ে দই, চিড়া এবং নিজের বাগানের আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু পেট ভরে খাইয়েছিলেন। পথে কখনো দেখা হলে পা ছুঁয়ে সালাম জানাতাম, দাঁড় করিয়ে আদর করতেন, আরো লোকজনদের বলতেন এ ছেলে আমার গর্ব, আমার এলাকার গর্ব, এলাকার ভবিষ্যত। মনে মনে ভীষন খুশি হতাম, যেমন করে সবাই কমবেশি এমনটা হয়।
পরীক্ষার পূর্বে বাড়ি থেকে ঘনিষ্ট কেউ বা বাবা আসলেও কিছুটা বিরক্তি বোধ করতাম বৈ কি। এসময় প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘণ্টা অনেক মূল্যবান বিশেষ করে মেডিকেল লাইফে। যদিও তখন সারাটাদিন স্যারের পেছনে চলে গেল, পড়াশোনা করতে পারিনি তবুও সামান্যতম খারাপ লাগেনি।
প্রায় দু’সপ্তাহ পর স্যারের পাঠানো মনি অর্ডার পেলাম। ফরমের নিচে খালি জায়গাটুকুতে স্পষ্ট করে সুন্দর হাতের লেখা, ‘আমার জীবন সার্থক, তোমাকে আজীবন মনে থাকবে, আশীর্বাদ রইল তুমি অনেক বড় হও’।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় বাজারে থেমে ডা. ফজলু চাচার ফার্মেসীতে বসে চা’টা খেলাম। অতঃপর বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই প্রাইমারিতেই ঝরেপড়া এক ক্লাসমেটের সাথে দেখা। তার প্রথম বুলি, ‘উপেন্দ্র স্যার আর নেই। গত সপ্তাহে হার্ট এ্যাটাক করে ইহলোকে ত্যাগ করেছেন।’
স্তব্ধ হয়ে নির্বাক কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ দুটো মনের অজান্তেই ছল ছল করে উঠল। অথচ ভেবে রেখেছিলাম দু’তিন দিন পর স্যারের বাড়িতে গিয়ে (প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে) স্যারকে একবার সালাম করে আসব।
আসলে সব আশা পূরণ হয় না। এখনও মাঝে মাঝে পিতৃতুল্য নিঃসন্তান সেই উপেন্দ্র স্যারের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে স্যারের নরম হাতের কোমল সেই স্পর্শ।
মনে পড়ে দার্শনিক প্লেটুর সেই কথা ‘আমি আমার জন্মের জন্য ঋণী মাতাপিতার নিকট কিন্তু জ্ঞানের জন্য যার নিকট ঋণী তিনি হলেন আমার শিক্ষাগুরু সক্রেটিস’।
আর সেই উপেন্দ্র স্যার ছিলেন আমার সেই শিক্ষাগুরু, আমার ছেলেবেলার সক্রেটিস।