ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
১৯৭৯ সাল।
বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কলেজ চত্বরের ফুটন্ত শিমুলের ডালে শালিকের আনাগোনা। বয়োঃসন্ধিক্ষণ ও কৈশোরের শেষ দু-আড়াই বছর এনাটমি এবং ফিজিওলজির ল্যাটিন ও গ্রীক শব্দের কষাঘাতে কেমন করে যে কেটে গেল টের পাইনি। মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে উত্তরণ – এ এক দারুণ ব্যাপার! নিজেকে অনেক হালকা মনে হয়। সকালের ক্লাস দুটো শেষ করে হাসপাতালে ওয়ার্ডে যাচ্ছিলাম। তখন থেকে সরাসরি রোগীর সাথে ক্লাস, কি মজা! স্টেথোস্কোপ ও ব্লাড প্রেশার যন্ত্রের ব্যবহার তখন থেকেই। গায়ে এপ্রোন, কাঁধে স্টেথো নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছিল!
লিফটের দিকে সদলবলে এগুচ্ছিলাম। রোগীদের আত্মীয় স্বজন সমীহ করে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছিল। তখন এমনটাই ছিল। এখন কেমন জানি না।
হঠাৎ লিফটের ভেতর থেকে গলা ছেড়ে কান্নার বিলাপ শুনতে পেলাম।
‘এখন কি করব আমি? কি হবে আমার?? তোমরাই বল…’
বিশ একুশ বছরের একটি মেয়ে মাঝারি বয়সের এক ভদ্রলোকের গলা জড়িয়ে আছে, সাথে বুক ফাটা কান্না। তার বাম হাতের কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজ। পরে জেনেছিলাম ভদ্রলোক মেয়ের কাকা হন। দু’তিনজন সিঁদুর পরিহিতা মহিলা আঁচলে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদছেন। আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে। কাকা জানালেন, হাতে খোঁচা লেগে গ্যাস গ্যাংগ্রীন সংক্রমণ হয়েছে। হাত সমেত পুরো বাম বাহু কেটে ফেলতে হবে। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নিজেই বলতে লাগলেন, খুব মেধাবী মেয়ে, এবার ডিগ্রীতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, তিন দিন পর বিয়ে, বিলেত ফেরত উচ্চ বংশীয় পিএইচডি অধুনারত সুদর্শন ছেলে। আজ সকালে সম্বন্ধটা ভেঙে দিয়ে গেল।
পাশে দাঁড়িয়ে গৌর বর্ণের ভদ্রলোক। নির্বাক, নিথর। চেহারায় আভিজাত্যের ভাব সুস্পষ্ট। পরনে সাদা ধবধবে ধুতি ও ফিনফিনে পাঞ্জাবী। চেহারার সাযুজ্যে মনে হল মেয়ের বাবা। এ মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস আমার হয়নি।
কাকা বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “কেমন অমানুষ। কি নিষ্ঠুর, এ সময় কেউ বিয়ে ভেঙ্গে দেয়!”
ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকালাম। শ্যাম ও হলুদের মাঝামাঝি গায়ের রং, ছিপছিপে গড়ন। আয়ত নয়ন, সাধারণত কৌলিন ব্রাহ্মণ মেয়েরা যেমনটা হয়। এলায়িত দু-এক গুচ্ছ কুন্তল অশ্রুভেজা গন্ডদেশের পশ্চাৎভাগ লেপ্টে আছে…..শোকের মাঝেও যেন এক অপরূপ দৃশ্য! অনেকটা শরৎচন্দ্রের আঁধারের রূপের মতোই।
উল্লেখ্য, গ্যাস গ্যাংগ্রীন টিটেনাস গোত্রীয় মারাত্মক সংক্রমণ ব্যধি। মাংশে পচন ধরে বুদবুদ আকারে গ্যাস জমে ত্বরিত উর্ধমুখী সংক্রমণ ঘটে। শল্যবিদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পুরো অঙ্গ কেটে ফেলতে হবে। নচেৎ মৃত্যু অনিবার্য।
অপারেশন থিয়েটারের দূরত্ব কমে আসার সাথে সাথে মেয়েটির কান্নার জোর বেড়েই চলছিল।
লিফটের দরজা খুলে গেল। ধীরপায়ে ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলাম, ফিরে তাকাবার সাহস হয়নি আর। দূরত্বের ব্যবধানে করুণ কান্নার সুকরুণ সুর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিলো।
পড়াশোনার চাপ এবং স্বলাজ বয়সের সংকোচতায় মেয়েটিকে আর অনুসরণ করা হয়নি। জানি না তার কি পরিণতি হয়েছিলো!
নানা সমীকরণ মাঝে মাঝে মনে ঘুরপাক খেয়েছে…
-হয়তোবা ঘাতক সংক্রমণে মেয়েটি মরে গিয়ে স্বজনদের কাছে আজো অমর হয়ে আছে..
-হয়তো অভিমানী মেয়েটি জীবনে কখনো আর ললাটে সিঁদুর ছোঁয়ায়নি
-হয়তোবা সাদামাটা গোছের একটা সাধারণ সাদামাটা জীবন!
-হয়তোবা অন্য কিছু. …!
আজ তিন যুগ পরেও ঝড়ো হাওয়ার মতো বয়ে যাওয়া ঐ তিন মিনিটের ক্ষুদ্র বিধুর স্মৃতিটুকু মনের দুয়ারে হঠাৎ করেই যেন কড়া নাড়ে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা অশীতিপর সুচিত্রা সেন সবার মনে যেমন করে চিরসবুজ, চির সুন্দর হয়ে বেঁচেছিলেন…
আমার মনের আকাশে মেয়েটি এতদিন পরও যেন তেমনি মিটিমিটি শুকতারা, জীবনানন্দ দাশের আকাশলীনা!
নিত্য ব্যস্ততায় ক্ষণিক অবসরে কেন জানি তার কথা আজো মনে পড়ে।