হবিগঞ্জের ধুলিয়াখাল এলাকায় জেলা কারাগারটি বেশ আধুনিক ও পরিপাটি

কারাগারের ভেতরে খেলাধুলার পর্যাপ্ত মাঠ রয়েছে। বিস্তর ভূমিতে সবজি বাগানও আছে। ভেতরে হাজতি-কয়েদিদের সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থাসহ বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কর্মকান্ড রয়েছে। মহিলা হাজতখানায় ৩০ জন কয়েদি-হাজতি আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে মুড়ি ভাজতে দেখলাম। নকশীকাঁথা সেলাই কাজেও কয়েকজন ব্যস্ত। মহিলা কারাবন্দি ওয়ার্ডের পাশেই রয়েছে শিশু-কিশোর কারাবন্দিদের ওয়ার্ড

আতাউর রহমান কানন

১৩ নভেম্বর ২০০৬, সোমবার। সকাল ৯-৫টা অফিস করি। আজ সকাল থেকে ১৪ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলছে। রাতে টেনিস খেলে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে টিভি খুলে বসছি। এমন সময় টিভি স্ক্রলে দেখি কিছুদিন আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রেস সেক্রেটারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া জনাব মোখলেছুর রহমান চৌধুরী (মোখলেছ চৌধুরী নামে খ্যাত)কে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় এবার মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এই চৌধুরী সাহেব আমার বেশ পরিচিত। তিনি ‘দৈনিক দিনকাল’ পত্রিকার কূটনৈতিক সংবাদদাতা এবং বৈদেশিক সংবাদদাতা সমিতি বাংলাদেশ (ওকাব)এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমি ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় তাঁর সাথে দেখা হতো এবং আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডাও দিতাম। এই রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় তিনি কোন ফরমূলায় রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হয়েছেন তা আমার মাথায় ধরল না।
আজ রাতের খবরে আরও দেখলাম, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ-সহ নির্বাচন পুনর্গঠন মানবে না। দেশের রাজনীতি যে ক্রমান্বয়ে জটিলতার দিকে যাচ্ছে তা অনুমান করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
১৫ নভেম্বর ২০০৬, বুধবার। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচির কারণে জেলা সদরের বাইরে কোনো কাজে যাওয়া হচ্ছে না। অফিস আর নির্ধারিত সভাসমূহ করে যাচ্ছি। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় জেলা কারাগারে দ্বিতীয়বারের মতো পরিদর্শনে যাই। প্রথমবার ঈদের দিন গিয়েছিলাম প্রথানুযায়ী কারাবন্দিদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও ঈদ উপলক্ষ্যে তাদের পরিবেশিত বিশেষ খাবার দেখার জন্য।
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মাসে একবার এই কারাগার পরিদর্শন অন্যতম রুটিন কাজ। আমার আজকে পরিদর্শনে যাওয়া উপলক্ষ্যে কারাগারে মোটামুটি একটা সাজসাজ রব। শহরের ধুলিয়াখাল এলাকায় নবপ্রতিষ্ঠিত জেলা কারাগারটি বেশ আধুনিক ও পরিপাটি। ভেতরটা পরিচ্ছন্ন ও গোছানো। হাজতি-কয়েদিদের গাদাগাদি অবস্থান নেই। একটা ৪তলা ভবন তো প্রায় ফাঁকাই পড়ে আছে। ভেতরে খেলাধুলার পর্যাপ্ত মাঠ রয়েছে। বিস্তর ভূমিতে সবজি বাগানও আছে। ভেতরে হাজতি-কয়েদিদের সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থাসহ বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কর্মকান্ড রয়েছে। মহিলা হাজতখানায় ৩০ জন কয়েদি-হাজতি আছে। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে মুড়ি ভাজতে দেখলাম। নকশীকাঁথা সেলাই কাজেও কয়েকজন ব্যস্ত। মহিলা কারাবন্দি ওয়ার্ডের পাশেই রয়েছে শিশু-কিশোর কারাবন্দিদের ওয়ার্ড। সেখানে প্রায় শতাধিক বন্দি রয়েছে। এদের বাছাই করে নানামুখি শিক্ষামূলক কর্মে নিয়োজিত করা আছে। সময় কাটানোর জন্য নানারকম ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে কারাবন্দিদের একঘেঁয়েমিতা কাটিয়ে মানসিক উৎকর্ষতা ঘটাতে সহায়তা করে।
জেলা কারাগার থেকে সকাল সাড়ে ১১টায় নিজ অফিসে ফিরে পূর্বনির্ধারিত কয়েকটি সভা পরপর করি। অফিস শেষে সন্ধ্যার লগনে বাসভবনে ফিরে আসি।
মাগরিবের নামাজ ও হালকা নাশতা শেষে আবার বাসভবনের অফিসে বসে কাজ করতে থাকি। ডিসির বাসভবন শুধু বাসভবন নয়। এর নিচতলার একাংশ অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অফিসে নিয়মিত কর্মচারীও রয়েছে।
১৬ নভেম্বর ২০০৬, বৃহস্পতিবার। সকালে অফিসে যাই। আজ থেকে ১৪-দলীয় জোট সাময়িকভাবে অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সরকার তাদের দাবি না মানলে আবার ২০ নভেম্বর থেকে অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হবে।
১৭ নভেম্বর ২০০৬, শুক্রবার। ছুটির দিনও ডিসিদের জন্য ছুটির দিন না। কোনো ফুরসৎ পাচ্ছি না নিজের ব্যক্তিগত কাজে করার। এদিকে নিজের মাথার চুল বাবরি আকার ধারণ করেছে। আজ সকালে বাসায় নরসুন্দর ডেকে এনে চুল ছাটাতে বসেছি; এর মধ্যে নিচে অফিসে ভিজিটর এসে বসে আছে। আর টেলিফোনও বেজে চলছে। ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখি বিগত চারদলীয় জোট সরকারের হবিগঞ্জ-৩ সদর-লাখাইয়ের এমপি আবু লেইছ মুবিন চৌধুরী। তিনি সৌজন্য আলাপের পর আমাকে জানালেন, লাখাইয়ে হাওড়ের এক বিলে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে একচোট মারামারি হয়েছে। তিনি আপাতত এলাকায় গিয়ে থামিয়েছেন। যেকোনো সময় বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। এই এমপি সাহেব হবিগঞ্জের একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক। তিনি এলাকায় ৪ বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। আমি তাঁকে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে তিনি সৌজন্যবশত চা-নাশতা খেয়ে চলে যান।
রাতের খবরে দেখলাম, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তারা বাংলাদেশে ফ্রি-ফেয়ার-নিউট্রাল নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের রেজুলেশন পাশ করেছে। আবার এদিকে বাংলাদেশ প্রিন্টিং শিল্প-প্রতিষ্ঠান সমিতি জনগণের টাকা অপচয় রোধকল্পে নির্বাচন কমিশনের ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা ছাপাতে অস্বীকার করেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে ভাবলাম, নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে!
১৮ নভেম্বর ২০০৬, শনিবার। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জেলা সদরের বাইরে পারতপক্ষে তেমন কোনো প্রোগ্রাম রাখছি না। আজ ছুটির দিন হওয়ায় দিনটি বাসভবনের অফিস-বাসা করেই কাটাই। দিনের বেলা একফাঁকে শুনলাম, আজও ডিসি প্রত্যাহার-বদলির একটি আদেশ আসছে। আমি এ নিয়ে তেমন ভাবছি না। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছি। তবে মনে মনে কামনা করছি, আমাকে যেন প্রত্যাহার করে ঢাকাতেই নেওয়া হয়। এতে আমার পরিবারের কাছে থাকা হবে। আর দেশের রাজনৈতিক বেতাল অবস্থার প্রশাসনিক টেনশন থেকে মুক্তি পাব।
দিন গড়িয়ে রাত নামে। টিভি চ্যানেলের ৯টার খবরে দেখলাম, ঠিক ঠিক ডিসিদের প্রত্যাহার-বদলির আদেশ হয়েছে। এতে ১৮ জন প্রত্যাহার ও ৩৩ জন বদলি-নিয়োগ হয়েছেন। তালিকায় আমার নাম এবারও নেই। তবে আশায় রইলাম- এবার বাদ পড়লেও পরের বার হবে।
পরদিন সকাল ৯টায় অফিসে গিয়ে দেখি আমার অফিসের এডিএম-এডিসিগণ আমার অফিসকক্ষে বসে আছেন। আমাকে দেখে তাঁরা জানালেন, আমার প্রত্যাহার-বদলি নিয়ে তাঁরা বেশ টেনশনে আছেন। আমি তাঁদের চায়ে আপ্যায়ন করে জানিয়ে দিলাম, টেনশনের কিছু নেই। আমি প্রস্তুত আছি। আর এতে আমার জন্য ‘শাপে বর’ হবে।
সাড়ে ১০টায় হবিগঞ্জ কিবরিয়া পৌর মিলনায়তনে যাই। সেখানে হবিগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃক আয়োজিত এবারের হজযাত্রী হাজিদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উদ্বোধন করি। সেখান থেকে সাড়ে ১১টায় নিজ অফিসে ফিরে কাজকর্ম করি।
হবিগঞ্জে এসে টেনিস ক্লাবে মাঝে মাঝে যাওয়া-আসা করছি। আজও রাত ৮টায় গিয়ে কিছুক্ষণ টেনিস খেললাম। রাতে বাসায় ফিরে টিভি সংবাদে দেখলাম, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় আগামীকাল থেকে তৃতীয় বারের জন্য ১৪দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি আবার শুরু হচ্ছে। রাজনৈতিক এ সমস্যা এখন জাতীয় বিপর্যয়ে রূপ নিচ্ছে। মানুষের জানমালের তো ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছেই, সেইসঙ্গে বাজারে জিনিসপত্রের ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখি দামের জন্য ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। অথচ আন্দোলনকারীরা জানাচ্ছেন, এ সবই নাকি দেশের মানুষের কল্যাণে হচ্ছে। মাঠ প্রশাসনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছি- দেশের সাধারণ মানুষের কাছে গদিতে ‘ক’ও যা, ‘খ’ও তা। (চলবে…)