সন্ধ্যারাতে একই এলাকার দুই যুবক শিশুটিকে তার পিতার দোকানের কাছ থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তাকে হত্যা করে ডোবার পানিতে জলজ ঘাসের নিচে লুকিয়ে রাখে ঘাতকরা

 

সুমন আহমেদ বিজয় ॥ মুক্তিপণের জন্য এক শিশুকে অপহরণ করে হত্যা করার অপরাধে দুই আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে না পারলে দুই আসামীকে আরো ৬ মাস কারাভোগ করতে হবে। গতকাল বুধবার আসামীদের বিরুদ্ধে এ রায় দেন হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-(৩) এর বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ হালিম উল্লাহ চৌধুরী।
দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলো মাধবপুর উপজেলার ১১নং বাঘাসুরা ইউনিয়নের শিবজয়নগর গ্রামের মোঃ তাউস মিয়ার ছেলে মোঃ জালাল উদ্দিন (২৫) ও মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার চান্দ গ্রামের আহম্মদ আলীর ছেলে মোঃ রাসেল উদ্দিন ওরপে কাটা রাসেল (২৭)।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি মাধবপুর উপজেলার শিবজয়নগর গ্রামের মৃত হুকুম আলীর ছেলে মোঃ সাবাশ আলী নিজের দোকানে প্রতিদিনের মতো ব্যবসা করতে থাকাবস্থায় রাত ৭টার দিকে তার ৭ বছর বয়সী ছেলে শাহপরান সদাই নিতে দোকানে আসে। এ সময় শাহপরান পাশ্ববর্তী বাছির মিয়ার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টিভি দেখছিল। কিছুক্ষণ পর শাহপরানকে আর সেখানে দেখা যায়নি। ছেলেকে না দেখে তাকে খুঁজতে থাকেন পিতা সাবাশ আলী। আত্মীয় স্বজনসহ সম্ভাব্য সকল স্থানে খোঁজাখুজি করে কোথাও তার সন্ধান পাননি। এরই মধ্যে অপহরণকারীরা শাহপরানের মুক্তির জন্য তার বাবার কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ পরিস্থিতিতে শাহপরানের পিতা বিষয়টি মাধবপুর থানায় জানান এবং ছেলে নিখোঁজের জিডি করেন। জিডি নং ৩৫৮ তারিখ ৭-০১-২০১৮। উক্ত জিডি’র তদন্তকালে প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোঃ মমিনুল ইসলাম বাদীর ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পিছনে কতিপয় লোক জড়িত রয়েছে মর্মে সন্দেহ পোষণ করেন। পরবর্তীতে মোবাইল কললিস্ট ও বিশ্বস্ত সোর্স নিয়োগের মাধ্যমে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে সাবাস আলীর একই সাকিনের আসামী মোঃ জালাল মিয়া ও মোঃ রাসেল উদ্দিন ওরফে কাটা রাসেলকে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানা এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ।
আটক মোঃ জালাল উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায় সে সহ তার সঙ্গী রাসেল উদ্দিন ওরফে কাটা রাসেল পরস্পর যোগসাজসে শাহপরানকে অপহরণ করে করে হত্যা করে লাশটি শিবজয়নগর গ্রামের আবুল কালাম মেম্বারের জমির পাশের ডোবার পানির উপরে ভাসমান জলজ ঘাসের নিচে গুম করে রেখেছে। আসামী মোঃ জালাল মিয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি নিহত শাহপরানের পিতা সাবাশ আলী বাদী হয়ে জালাল মিয়া, রাসেল মিয়া ও বাহার মিয়াকে আসামী করে মাধবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ দীর্ঘ তদন্ত শেষে জালাল মিয়া ও রাসেল মিয়াকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। কোন অভিযোগ না থাকায় বাহার মিয়াকে চার্জশীট থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট মো. আবুল হাসেম মোল্লা মাসুম জানান, শিবজয়নগর গ্রামের জালাল মিয়াসহ তাদের লোকজনের সাথে বাড়ির জায়গা সম্পত্তি নিয়ে পার্শ্ববর্তী সাবাশ আলীর বিরোধ ছিল। এরই জের ধরে জালাল মিয়াসহ তাদের লোকজন ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি সাবাশ আলীর ৭ বছরের শিশু সন্তান শাহপরানকে অপহরণ করে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণের টাকা না পেয়ে তাকে হত্যা করে মরদেহ ফেলে রাখে গ্রামের একটি ডোবায়।
আলোচিত এই মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহন শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় আসামী মোঃ জালাল মিয়া ও মোঃ রাসেল উদ্দিন ওরফে কাটা রাসেলকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ৭ ধারা ও ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৩০২/২০১ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন বিজ্ঞ বিচারক। আসামীদের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করা হয়। রায় শুনে আসামীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল হবিগঞ্জ এর স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট আবুল হাসেম মোল্লা মাসুম ও স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট মোস্তফা মিয়া।
আসামীপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। তিনি জানান, আসামীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবে।