জালাল আহমেদ
ভীমরাজকে হারানোর দুঃখ আমি এখনো ভুলি নাই

সময়ের পরিক্রমায় খাগড়াছড়িতে আমার তৃতীয় বর্ষা চলে আসলো। বর্ষায় পানছড়ির একটা সুবিধা হলো যে কোন ভদ্রলোকের আগমন ঘটে না আর আমি এজলাসে বসি ১৫ দিন অন্তর ফলে বেশী এক্সপোজড হবারও প্রয়োজন নাই। তাই বৃষ্টি আসলেই শেভ বন্ধ করে দেবদাস সাজি। অলস সময় কাটাই আর চট্টগ্রাম থেকে আনানো বই ম্যাগাজিন পড়ি। সেটলার এক হাতুড়ে ডাক্তার, ডাক্তার হাবিব কিভাবে জানি বইপত্র চিনে, ফলে তাঁর মাধ্যমে চট্টগ্রাম রেলওয়ে বুক স্টল বা কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে বই আনাতে পারছিলাম। মে মাসে ফিরে আসার পরই পানছড়ি বাজারের রাজা মিয়া আমাকে একটা বড় ভীমরাজ বা গ্রেটার র‌্যাকেট টেইল্ড ড্রোংগো এনে দেয়। আমি বেশ কিছুদিন এই ভীমরাজ পালন করি। এর আগে কখনো আমি ভীমরাজ পালিনি যদিও পালা যায় এমন সব পাখিই আমি ছোটবেলা থেকে পালন করেছি।
ভীমরাজ এর সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল তার খাদ্যাভ্যাস, খায় মাংস, মাছ আর পোকা। ফলে খাঁচায় গন্ধ হয়ে যায়, নইলে চমৎকার পাখি। কথা বলে ময়নার চেয়েও স্পষ্ট। তাকে বাসার দক্ষিণপাশের লেক থেকে নাইলোটিকা মাছ ধরে খাওয়াতাম। পরিষদ আংগিনায় যে সাঁওতালরা কাজ করতো তারা ঝিঁঝিঁ পোকা (উরতুংগা বা তুরকুলা) ধরে দিত, কখনো মাংসের ছাট।
পাখিটার বড় গুন ছিল সে পোষ মেনেছিল। আমি কোর্ট বা অফিস থেকে হেঁটে ফিরতাম, বাসার গেটে হাত দেয়া মাত্র সে টের পেয়ে যেত, শুরু হয়ে যেত ছটফট আর চীৎকার! আমি বাসায় ফিরে তাকে ছেড়ে দিতাম আর সে আমার পায়ে পায়ে ঘুরতো। আমি বাইরে বেতের চেয়ার নিয়ে বসতাম, সে আমার কাঁধের কাছে বা কখনো কাঁধের উপর তার ধারালো নখ নিয়ে বসে থাকতো। কখনো চেয়ারের নীচে আড়াআড়ি বেতের উপর বসে থাকতো। কখনো আমার সঙ্গে কথা বলতো। বনের পাখী ভীমরাজ বহু পাখীর ডাক নকল করায় ওস্তাদ, এখনো যখন বনে ভীমরাজের সঙ্গে দেখা হয় সে কয়েকরকম পাখীর ডাক একাই ডাকতে থাকে। সন্ধ্যা হলে সে ধীরে ধীরে বাসার পেছনে তার খাঁচার দিকে যায় ও খাঁচার উপরে বসে থাকে, বাবুর্চি সিরাজ বা পিয়ন বিপুল তাকে খাঁচায় ঢুকায়। একদিন সন্ধ্যায় আমি বাইরে বসে আছি, সে ভেতরে, বাসার পেছনে তার খাঁচার কাছে চলে গিয়েছে, কোন সাড়া শব্দ নাই। সন্ধ্যা পার হয়ে গেলে আমি সিরাজকে ডাকি, ‘সিরাজ, পাখি খাঁচায় রাখছো’ সে বলে, ‘না, রাখি নাই’। লাফ দিয়ে উঠে পেছনে গেলাম, খাঁচার উপরে পাখি নাই! আর পেলাম না, নো ট্রেস! ভীমরাজকে হারানোর এই দুঃখ আমি এখনো ভুলি নাই!
তখন বর্ষার শেষ প্রায়, আমি শিকারে বের হতে শুরু করি। আমার .২২ বোরের একটা রাইফেল ছিল, তা নিয়েই বের হতাম। ততদিনে আমার দুই বছর হয়ে গিয়েছে এবং আমি মনে করতাম যে লোকজন আমাকে চেনে। প্রথমে মহকুমায় একা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলায় এনডিসি এবং মার্শাল’ল লিয়াঁজো অফিসার ও ওসি বাজার ফান্ড থাকায় একটা পরিচিতি ছিল আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রে আরেকটা পরিচিতি। পানছড়িতে আসার পর মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা’র বড় বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা (মিনু) কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমাকে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন পানছড়ি উপজেলা সদরের দক্ষিণপূর্ব দিকে একটা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। এটাও আমাকে সাহস যোগাতো। শীতের শুরুতে তিনি আমাকে একজোড়া হাতে বুনানো গায়ের চাদর উপহার দেন। আমি তখন এ ধরণের প্রসংগ উঠলে বলতাম, “লারমার বোনের দেয়া চাদর যে গায়ে দেয় তাঁর আবার শান্তি বাহিনীর কিসের ভয়!” তাই আমি রাইফেল নিয়ে শিকারে বের হলে শান্তি বাহিনীর ভয় পেতামনা আর সেনাবাহিনীও আমাকে কোন বাঁধা দেয় নাই। আমার এই প্রাত্যহিক ৩ থেকে ৬ মাইল হাঁটাতে পরিষদের আশেপাশের টপোগ্রাফি সম্পর্কে খুব ভালো ধারনা হয়। আশেপাশের গ্রামের লোকেরা আমাকে চিনতে থাকে আর আমি বিভিন্ন কথা বার্তা’র সূত্রে তথ্য পেতে থাকি।
আমার এক স্মার্ট পিয়ন ছিল নওয়াব আলী, লুঙ্গী পড়া, মুক্তিযোদ্ধা। সে প্রচুর তথ্য পেত। একাধিক উপলক্ষে দেখা গেল যে আমি সন্ধ্যায় যে তথ্য ব্যাটালিয়ন সদরে বসে সিও বা ২আইসি’র সঙ্গে শেয়ার করেছি তা হয়তো ফরমাল চ্যানেলে দু’দিন পর পাওয়া গিয়েছে। এমন কি কিছু মুভমেন্ট ইনফরমেশনও আমি আগে পেয়ে যেতাম। সিও আমাকে বললেন যে তিনি আমাকে ব্যাটালিয়ন আন-অডিটেড ফান্ড থেকে কিছু টাকা দেবেন আমার নেটওয়ার্ক মেইনটেইন করার জন্য। আমি রাজি হলাম না, বললাম ‘স্যার, আপনার সঙ্গে যে সম্পর্ক তা পরের সিও’র সঙ্গে নাও থাকতে পারে, এটা ঠিক হবে না।’ তিনি মেনে নিলেন। বাস্তবে পরের সিও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমত আহমেদ চৌধুরী বীরপ্রতিক এর সঙ্গেও আমার ভালো সম্পর্ক ছিল এবং আজ ৩৫ বছর পরেও উনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। এরমাঝে একদিন লোগাং এর চেয়ারম্যান জগদীশ চন্দ্র চাকমা আমাকে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। জগদীশ সেনাবাহিনীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এবং সেনা কর্মকর্তাগণ হালকা কথাবার্তার সময় তাঁকে ব্রিগেডিয়ার জগদীশ বলে সম্বোধন করতেন। দাওয়াতটা একটু অস্বাভাবিক কারণ কোন উপলক্ষ্য ছিল না। ইউএনও, এসি বা ওসিকেও দাওয়াত দেয়া হয়নি। আমি কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে বিষয়টা শেয়ার করলাম। তিনি আপত্তি করলেন না, বললেন যে “আমরা উপযুক্ত প্রটেকশন দিব, আপনি ঘুরে আসেন।”
জোন ক্লিয়ারেন্স পেয়ে দাওয়াত নিলাম ও নির্ধারিত দিনে দাওয়াত খেতে গেলাম। আমার ভয় নয়, একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল, কারণ আমার সঙ্গে দুই সেকশন সৈন্যের একটা বি টাইপ পেট্রল, আর ৮ কিলমিটার পুরো পথ সেনাবাহিনী কভার করেছিল। মূল কারণ ছিল ঐ সময়ে জগদীশ চাকমা সেনাবাহিনীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং একমাস পরে, অক্টোবর ১৯৮৫ সালে শান্তিবাহিনীর ‘লাম্বা’ গ্রুপের সঙ্গে লোগাং ইউনিয়ন পরিষদে যে মিটিং হয় তার আয়োজন করেছিলেন এই জগদীশ চাকমা। আমি জগদীশ চাকমার বাড়িতে গেলাম, একটা টিলার উপর তাঁর বাড়ি আর বাড়ির পেছনেই বিশাল এক উপত্যকা যেখানে শান্তিবাহিনীর তখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের স্থান। খাবার ছিল খুবই ভালো, পাহাড়ী রান্না এবং আমাদের ধরণের উভয় রান্না ছিল। আমার সংগের বিশাল দলকেও খাওয়াতে হয়েছিল। আমি যখন ২০০৮ এবং ২০০৯ এ পানছড়ি যাই দু’বারই জগদীশ চন্দ্র চাকমাকে আমি খবর দিয়ে গিয়েছি এবং তাঁর সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে কিন্তু কখনো তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়নি কেন তিনি আমাকে ১৯৮৫ এর সেপ্টেম্বরে এই সম্মান দেখিয়েছিলেন।