জালাল আহমেদ
আমরা একজন অফিসারকে শুরুতেই আনএথিকাল প্র্যাকটিস বা ইমমরাল প্র্যাকটিসের দিকে ঠেলে দেই

আমরা গ্রাম সমীক্ষায় যাবার আগেই তৃতীয় বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হয়। তার টাইমিং এমনভাবে করা হয়েছিল যে তারা আসামাত্র আমরা গ্রাম সমীক্ষায় চলে যাই। আমরা ফিরে আসার পর প্রায় একমাস আমরা একসঙ্গে ছিলাম। তখন ড. এটিএম শামসুল হুদা সাহেব একটা যৌথ অধিবেশনের আয়োজন করলেন যার বিষয় ছিল “এথিক্স এন্ড মরালিটি ইন পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন”। এতে প্যানেলিস্টদের মধ্যে ছিলেন কমিশনার কাস্টমস হিসাবে খ্যাত শাহ আবদুল হান্নান (পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান) এবং অন্যরা। সেই অধিবেশনে আমিও একজন বক্তা ছিলাম এবং সেখানে আমার আব্বার রাজস্থলী এবং আমার পানছড়ি পোস্টিং এর প্রসংগ তুলে বললাম যে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এমন অবস্থা তৈরী করতে চায় যে একজন অফিসার তাঁর কাজ বাদ দিয়ে পোস্টিং এর পেছনে ঘুরে বেড়াক, নিজে তদবির করুক বা তদবিরকারক যোগাড় করুক। কারণ আব্বাকে রাজস্থলী না পাঠালে তিনি হয়তো ১১ বছর চাকুরী করে স্বাভাবিক অবসরে যেতেন। অবস্থা এখনো তেমনি, খুব একটা বদল হয় নাই। আমরা একজন অফিসারকে শুরুতেই আনএথিকাল প্র্যাকটিস বা ইমমরাল প্র্যাক্টিসের দিকে ঠেলে দেই। ১১ মে ১৯৮৫ আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয় এবং তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নুরুল ইসলাম আমাদের সনদপত্র প্রদান করেন।
এরমধ্যে আবার ‘চেঞ্জ অব গার্ড’ ইন খাগড়াছড়ি, এএমএম রেজা ই রাব্বি’র স্থলে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে এসেছেন মোল্লা গোলাম সারওয়ার, ১৯৬৮ সালের ইপিসিএস। এডিসি ছিলেন কুষ্টিয়াতে, পরবর্তীতে আমার বন্ধু ১৯৮৪ ব্যাচের কর ক্যাডারের একেএম আনোয়ার হোসেন এর শ্বশুর। রাব্বি স্যারের বিদায় ছিল খুবই দুঃখজনক। স্যারের এক মেয়ে ছিল, তিন্নি। খাগড়াছড়িতে থাকাকালে স্যারের এক ছেলে জন্ম নেয়। কয়েক মাস বয়সী সেই ছেলেসহ স্যার ভাবি যাচ্ছিলেন ঢাকায়। পথে ময়নামতি’র নিকটে এক সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ তেমন আহত না হলেও শরীরে প্রকাশ্য কোন আঘাত ব্যাতীরেকে স্যারের সেই ছেলে মারা যায়। এতে ভাবির জন্য খাগড়াছড়ি বাংলোতে থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে, বেডরুম চেঞ্জ করেও অবস্থার উন্নতি হয়নি। তখন স্যারকে নরসিংদীতে জেলা প্রশাসক হিসাবে বদলি করা হয়।
ফলে এই দফা আমি পানছড়িতে সেটেল্ড হয়ে যাই। আমার কোর্ট বিল্ডিং এর কাজ সমাপ্ত হয় এবং এসজেডএমএলএ-২০ তা’ উদ্বোধন করেন। বড় পরিবর্তন হলো পানছড়িতে একটা ব্যাটালিয়ন সদর স্থাপিত হয়। ১৯ ইস্টবেংগল আসে পানছড়িতে ফলে উপজেলা পরিষদ অংগনের দক্ষিণাংশ ছেড়ে দিতে হয় তাদের জন্য। পরিষদ মাঠের দক্ষিণে, পুরনো কোর্টের সামনে দিয়ে তাদের রাস্তা হয় আর গেজেটেড অফিসার কোয়ার্টার হয় তাদের সদর দপ্তর। ব্যাটালিয়ন সদর হওয়াতে আমার যেটা সুবিধা হল বেশ কিছু অফিসার চলে আসলো আমাদের কম্পাউন্ডে ফলে গল্প করার বা সময় কাটানোর আরেকটু ভালো উপায় হলো। একই সংগে আমাদের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ও উন্নতি হল।
এর আগে ১১ মাস সিভিল লিয়াঁজো অফিসার হিসেবে কাজ করায় বেশিরভাগ অফিসার আমার চেনা আর আমিও তাঁদের সঙ্গে মিশতে স্বচ্ছন্দ। ১৯ বেঙ্গল এর সিও ছিলেন লেঃ কর্ণেল মাহমুদ মতিন মোহাম্মদ কায়সার আর ২আইসি মানে সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন প্রাক্তন রক্ষীবাহিনী লিডার নরসিংদীর মেজর শাহজাহান। পরে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয় যখন তিনি বগুড়া ৪২ ইস্টবেংগল এর সিও। আর কর্ণেল কায়সার অকালে মৃত্যুবরণ করেন। একজন কমান্ডো মেজর আনিস ছিলেন ঝর্নাটিলা (পুরনো নাম পানিটিলা) ক্যাম্পে আর নালকাটা ক্যাম্পে ছিলেন মেজর শামস, বিয়ে করেছিলেন রাঙ্গামাটিতে। ক্যাপ্টেন রকিব ছিলেন ভাইবোনছড়া ক্যাম্পে যিনি ইউএনও সাহেবকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। এই সময়ে ইউএনও সাহেবের এক দাওয়াত এলো লোগাং হাইস্কুল থেকে। লোগাং হাই স্কুল লোগাং বাজারে, সদর থেকে ৩ মাইল উত্তরে। লোগাং ছড়ার পানি লাল বলে এর নাম লহু গাং-রক্তনদী। আর ৪ মাইল উত্তরে পুজগাং ছড়া, পানি ঘোলা বলে নাম পুজগাং। দুটো ছড়ার মিলিত ধারার নামই চেংগী নদী। লোগাং স্কুলে’র প্রোগ্রামের বিষয়ে ইউএনও সাহেব আগেই ক্যাপ্টেন রকিব এর সঙ্গে কথা বলেছেন। ঐদিন ক্যাপ্টেন রকিব সিভিল ড্রেসে আমাদের সঙ্গী হলেন। স্কুলের প্রোগ্রামে লোগাং এর চেয়ারম্যান জগদীশ চন্দ্র চাকমা এবং পুজগাং এর চেয়ারম্যান অনুপম চাকমা উভয়েই ছিল।
আমরা স্টেজ থেকেই লক্ষ্য করছিলাম যে জগদীশ চাকমা একটু অস্থির, আর একটু পর পর বাইরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর স্টেজে এসে ইউএনও সাহেবকে বললো যে স্যার আপনারা চলে যান। সঙ্গে সঙ্গে আমি , ইউএনও সাহেব ও ক্যাপ্টেন রকিব বেরিয়ে এসে উপজেলার জীপে উঠলাম। ফ্রন্ট সিটে প্রথমে ক্যাপ্টেন রকিব, তাঁর পর ইউএনও আর আমি জানালার পাশে। চালক সোবহান গাড়ি ছেড়ে দিয়ে একটানে উপজেলা সদরে। পরদিন জানা গেল যে শান্তিবাহিনী লোগাং ছড়ার ওপারে আসছিল ইউএনও সাহেবকে নিয়ে যেতে। তিনি হৃদরোগী, ডায়াবেটিক, জগদীশ এসব বলার পরও তারা বলছিল যে তাদের ডাক্তার আছে, দেখে শুনে রাখবে, ওই অবস্থায় আমরা চলে আসতে পারি। এর কিছুদিন পর ইউএনও সাহবের বদলি হয়ে যায়। অসাধারণ একজন পিতৃতূল্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন রফিক উদ্দিন মোল্লা।
নতুন ইউএনও এলেন মাহবুবুর রহমান, বাড়ি কুড়িগ্রামে, মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭৩ ব্যাচ। আগে কখনো পার্বত্য এলাকায় চাকুরী করেননি এবং স্বভাবগতভাবে একটু কম সাহসী।
ইতোমধ্যে উপজেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচন, পরিষদের চেয়ারম্যান আসবে। আমি চিন্তিত ছিলাম গাড়ি নিয়ে। পরিষদের গাড়িতে জেলা সদরে মিটিং এ যদি আমাকেও আসতে হয় তবে জীপে বসবো কোথায়? চালক সোবহানকে বললাম সমস্যাটা। পরে যেদিন খাগড়াছড়ি মিটিং এ এলাম বিকেল বেলা সরকারী স্কুলের মাঠে গাড়ি চালানো প্র্যাকটিস শুরু করলাম। ৪০ মিনিট প্র্যাকটিস করলাম। পরদিন সকালে আরো ২০ মিনিট প্র্যাকটিস করে সোবহানকে পাশে বসিয়ে ১৬ মাইল চালিয়ে পানছড়ি চলে আসলাম। আমার গাড়ি চালানো শিখানোর ওস্তাদ, সোবহান। কিছুদিন পর শপথ নিয়ে যখন চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদ রাজকুমার চাকমা দায়িত্ব নিলেন তখন অন্ততঃ এই একটি সমস্যা হবে না ভাবলাম। কিন্তু আসলে পেলাম তার চেয়ে বেশি। রাজকুমার চাকমা ছিলেন ভদ্রলোক এবং তার সংগে উপজেলা পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বের প্রথম দিনগুলোতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা অন্যদের তেমন কোন বড় ধরনের মতানৈক্য হয়নি। তিনি সপরিবারে নন-গেজেটেড কোয়ার্টারগুলোর একটার দোতলায় উঠেছিলেন যার পাশের ফ্ল্যাটে পরে আমি উঠি মানে তিনি ছিলেন আমার ‘নেক্সট ডোর নেইবার’। রাজকুমার চাকমা’র একটা পুরনো কার ছিল, তিনি যখন জীপ নিয়ে কোথাও যেতেন তখন অবশ্যই তাঁর কার এর চাবি আমাকে দিয়ে যেতেন ফলে আমি চেয়ারম্যান এর কার নিয়েও অনেকবার খাগড়াছড়িতে এসেছি।