জালাল আহমেদ
আমরা যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম তাঁরা ছিলেন অসাধারণ
আমাদের দেশে অভিভাবকরা নিজেদের বাচ্চাকে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর বাইরে খুব একটা কিছু চিন্তা করতে পারেন না। ফলে বাচ্চা অঙ্কে খারাপ হলেও তাকে জোর করে বিজ্ঞানে দেবার চেষ্টা করেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার জীবনটাকে ধবংস করেন।
১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে সিলেট তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় যদিও র্যাডক্লিফ সাহেব যখন ম্যাপে দাগ কাটেন তখন করিমগঞ্জ শহর সহ মহকুমার একটা বড় অংশ ভারতে রেখে দেন।
১৯৭২ সালে আমরা কোন পরীক্ষা ব্যাতীরেকে অটো প্রমোশন নিয়ে সপ্তম শ্রেণীতে উঠি। সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠতে একটা পরীক্ষা হয়, সম্ভবতঃ ৩০০ নাম্বারের। অষ্টম শ্রেণীতে কিছুটা নিয়মিত পড়ালেখা হতে থাকে। তখন কোনভাবে জানতে পারি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমার একটা ভুল ধারণা ছিল যে এখান থেকে পাশ করলে সরাসরি সিভিল সার্ভিসে যোগদান করা যাবে। তাই আমি লক্ষ্য স্থির করি যে এইচএসসি’র পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে ভর্তি হবো। ১৯৭৪ সালে নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে বিজ্ঞান না মানবিক বিভাগ নিব এই প্রশ্ন আসে। বাংলাদেশে এটা একটা জটিল সমস্যা। আমাদের দেশে অভিভাবকরা নিজেদের বাচ্চাকে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার বানানোর বাইরে খুব একটা কিছু চিন্তা করতে পারেন না। ফলে বাচ্চা অঙ্কে খারাপ হলেও তাকে জোর করে বিজ্ঞানে দেবার চেষ্টা করেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার জীবনটাকে ধবংস করেন। এখনকার সময়ে সুযোগও তো অনেক বেশী, প্রাইভেট সেক্টর এখন অনেক বেশী বিকশিত, আর্থিক সেক্টরেও কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেশী। তবুও অনেক অভিভাবক এখনো এই কাজটি করে থাকেন। আমার সৌভাগ্য যে আমার অভিভাভক বিবেচক ছিলেন এবং আমার মানবিক শাখায় পড়ার ইচ্ছায় তারা কোন বাধ সাধেননি। এর ফল আমি পাই নবম থেকে দশম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হয়ে। আমি প্রত্যাশা করবো যে সকল অভিভাবকই তাঁদের সন্তানদের তাদের ঝোঁক (এপটিচ্যুড), আগ্রহ এবং বিষয়বস্তুর দক্ষতা অনুযায়ী জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা করবেন।
আমাদের স্কুল, হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় ১৮৫৭ সালে মিডল ইংলিশ বা এমই স্কুল হিসেবে স্থাপিত হয়, ১৮৮৩ সালে উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী তাঁর “জালালাবাদের কথা” গ্রন্থে উল্লেখ করেন “হবিগঞ্জ শহরে যে স্কুলটির নাম উল্লেখিত হইয়াছে ইহা ১৮৪৩ খ্রীস্টাব্দে তরফের লস্করপুরে স্থাপিত হইয়াছিল, পরে মহকুমা সদর হবিগঞ্জে স্থানান্তরের সময় ঐ স্কুলটিকেও লস্করপুর হইতে হবিগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়।” আমি সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার পর ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ১৯৪৭ ব্যাচ এর এসএএমএস কিবরিয়া, আমার বড় চাচা ডাঃ আবদুল মাননানও ছিলেন ১৯৪৭ ব্যাচ। তাদের মেট্রিক পরীক্ষা হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। অনেকেই জানেন যে সিলেট ছিল তখন আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। শুনতে আশ্চর্য লাগে যে পুরো ভারতবর্ষে কেবল সিলেট জেলাতে গণভোট হয়েছিল যে আমরা আসামে তথা ভারতে থাকবো না পাকিস্তানে থাকবো। ৬/৭ জুলাই ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষ জয়ী হয় এবং সিলেট তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় যদিও র্যাডক্লিফ সাহেব যখন ম্যাপে দাগ কাটেন তখন করিমগঞ্জ শহর সহ মহকুমার একটা বড় অংশ ভারতে রেখে দেন।
আমাদের সময়ে শিক্ষকমন্ডলী যাদেরকে আমরা পেয়েছিলাম তারা ছিলেন অসাধারণ। শুধু পরীক্ষার জন্য তৈরী করা নয়, মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাতে তাদের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। স্কুলে প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাই জনাব সানওয়ার বখত চৌধুরীকে। অত্যন্ত নামকরা প্রধান শিক্ষক, কঠোরতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তখন স্কুলে বেত্রাঘাত ছিল অন্যতম শাস্তি। প্রধান শিক্ষকের রুমে বেত রাখার স্ট্যান্ড ছিল যাতে সাইজ অনুযায়ী নাম্বার দেয়া বেত থাকতো। তিনি বলতেন, “গফুর, তিন নাম্বার বেত নাও” বা “গফুর, পাঁচ নাম্বার বেত নাও!”। ১৯৭২ এ তিনি ছিলেন না। ১৯৭২ এর মাঝামাঝি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন জকিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আগত জনাব আব্দুল হামিদ মজুমদার। তিনি চাঁদপুর হাসান আলি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা খুব ভালো ছিল না এবং স্কুলে খুব একটা প্রভাবও রাখতে পারেননি। পরে তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন এবং ১৯৮৬ তে তাঁকে আমি চাঁদপুরের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে দেখেছি। তারপর আমাদের স্কুলে আসেন জনাব কাজী বদরুদ্দিন হায়দার, অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পন্ন প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। তাঁর সময়ে আমাদের স্কুল অনেকখানিই পাল্টে যায়। তিনি স্কুল ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তাঁর অন্যতম হাউজ বিভাজন পদ্ধতি। স্কুলের ছাত্ররা পাঁচটি হাউজে বিভক্ত ছিল এবং বিভিন্ন আন্তঃহাউজ প্রতিযোগিতা লেগেই থাকতো। আমি সুযোগ পাই স্কুল ক্যাপ্টেন হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে উপস্থাপনের, স্কুলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে বক্তৃতা করার সুযোগ পাই। বিশেষ করে মনে পড়ে বাকশাল পদ্ধতিতে বঙ্গবন্ধু যখন জেলা গভর্ণর নিয়োগ করেন তখন হবিগঞ্জ এর জেলা গভর্ণর অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী এমপিকে স্কুলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে হল-মঞ্চ সাজানোর দায়িত্বও ছিল আমার উপর। মঞ্চে চারটি গোলতলি ফ্লাস্কে স্কুলের বিখ্যাত তিনকোনা পুকুর থেকে লাল শাপলা দেয়া হয়। আমার বক্তৃতায় চারটি ফ্লাওয়ার ভাসকে জাতীয় চারনীতির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেছিলাম। স্কুলের বিশাল প্রাঙ্গণে আমরা বিভিন্ন জাতের বৃক্ষরোপণ করি, কলা বাগান করি। স্কুলের শিক্ষকগণও নতুন উদ্যমে আমাদের পাঠদানে ব্রতী হন। সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল মালিক স্যার, গণিতের শিক্ষক কিরণ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বিজ্ঞানের শিক্ষক অজিত চন্দ্র দাস, ভুগোলের শিক্ষক আবুল হাসান স্যার, ইংরেজীর অসাধারণ শিক্ষক অরবিন্দ ভট্টাচার্য, ক্রীড়া শিক্ষক নুরুন্নবী স্যার, সিদ্দিক আলী স্যার, টি আলী স্যার, আব্দুর রহমান স্যার, আবদুল ওহাব স্যার সহ সকল শিক্ষকই আমাদের উৎকর্ষতার জন্য অবদান রেখেছেন। ক্লাশের ফার্স্ট বয় হিসেবে সবাই আশা করছিল যে এসএসসি পরীক্ষায় মহকুমা থেকে আমিই প্রথম বিভাগ পাবো। শহরে আরেকটি সরকারী বিদ্যালয়, বালিকাদের, থাকায় দুই স্কুলের একটা কম্পিটিশনও ছিল। আমার বাসা থেকে বালিকা বিদ্যালয় পার হয়ে আমাদের স্কুলে যেতে হত। স্কুলে যেতাম বেশীর ভাগ সময় হেঁটে এবং যে সকল মেয়ে আমাদের স্কুলের উত্তর দিক থেকে আসতো তাদের সঙ্গে কোথাও না কোথাও ক্রস হত। তাদের মধ্যে কেউ মুখ চেনা আর কেউ পরিচিত, কেউ বন্ধু হয়ে যায় এবং পরীক্ষার জন্য অঘোষিত প্রতিদ্বন্ধী। তাদের মধ্যে ছিল নাসরিন হোসেন পাপড়ি, হেলালুসসামা জেসমিন, শায়লা পারভিন দিপা। পাপড়ি’র বড়ভাই জুলফিকার হায়দার চৌধুরী ১৯৭০ সালের ইপিসিএস পরীক্ষা পাশ করে সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন, তখন হয়তো মুন্সীগঞ্জে কর্মরত। মোটামুটি সকল বিষয়ে আমার দক্ষতা থাকলেও আমার দুর্বলতা ছিল গণিতে। টেস্ট পরীক্ষায় অংকে খারাপ করায় আমার সকল চেষ্টা ছিল অংককে ঘিরে ফলে পরবর্তীতে মূল পরীক্ষায় আমার শক্তির জায়গাগুলোতেও খারাপ নাম্বার আসে বলে দেখতে পাই। আমাদের পরীক্ষা হয় ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে। তখনকার পরীক্ষার রুটিন ছিল ভিন্ন। যে সকল বিষয়ে দুই পেপার ছিল তা সাধারণতঃ একই দিনে হত। ফলে রুটিন ছিল স্বল্পদিনব্যাপী এবং অনেক দিনই দুই বিষয়ের পরীক্ষা থাকতো। এতে আমাদের খুব বেশী অসুবিধা হয়েছে মনে করি না কিন্তু এখনকার সময়ে তা কল্পনাও করা যায় না। আমি যেহেতু সরকারী স্কুলে পড়তাম তাই আমার পরীক্ষার সিট আমাদের নিজের স্কুলেই ছিল। মফস্বলের স্কুলের প্রচুর ছেলে পরীক্ষা দিতে সদরে আসতে হত নানা অসুবিধার মাঝে। তার মাঝেই তারা কেউ কেউ অসধারণ ভালো ফলাফল করতো।