জালাল আহমেদ
ওইদিন বুল্লা বাজারে কাছ থেকে পাক হানাদারদের দেখলাম ॥ তাদের সঙ্গে রাজাকার ছিল, ছিল স্থানীয় দু’একজনও

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আশেপাশের যতো বাজার বা ব্যবসাকেন্দ্র আছে তাতে স্বাভাবিক ব্যবসাপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্থানীয় রাজাকারদের অত্যাচার একটি প্রধান কারণ, তার ওপর পাক হানাদার বাহিনীর ভয়তো ছিলই। স্থলপথে বুল্লা বাজারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলপথের কারণে বুল্লা বাজারের ব্যবসা বাড়তে থাকে। আশেপাশের সব বাজারের ক্রেতারা বুল্লা বাজারে আসতো। শনি ও মঙ্গলবারে জমজমাট বাজার বসে। বাজার বারে আমিও বাজারে যেতাম। সাত মামার ভাগিনা হিসেবে একটু বাড়তি খাতিরতো ছিলই। বাজার বারে আমার জন্য বরাদ্দ ছিল এক টাকা। আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার বাদামের সেরও তখন এক টাকা। এক ছটাক বাদাম এক আনা। ফলে এক টাকা অনেক বড় অংক ছিল আমার জন্য। এছাড়া ছিল কাটাগজা, আমরা বলতাম কাডাগজা, ডায়মন্ড শেপ ময়দা দিয়ে তৈরি সঙ্গে চিনির সিরা দেয়া। যুদ্ধের বাজারে চিনির অভাবে গুড় দিয়ে তৈরী হতে লাগলো, স্বাদও পরিবর্তন হয়ে এক নতুন খাবারে রুপান্তরিত হলো।
জুলাই মাসের কোন একদিন আমি অন্য কাজিনদের নিয়ে বাজারে। হাটবার, প্রচন্ড ভিড়ের মাঝেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আর কিছু কেনা যায় কি না দেখছি। হঠাৎ বাজারে হৈ চৈ শুনা গেল, ‘পাঞ্জাবী’ আইছে, ‘পাঞ্জাবী’ আইছে! কিছু মানুষ তাৎক্ষণিক দৌঁড়াতে শুরু করলো। বাজার মুহূর্তে খালি হয়ে গেলো কিন্তু যারা বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে এসেছিল তাদের অনেকেই বসে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাজারে মিলিটারী আসলো। তারা লাইন ধরে বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলো। ওইদিন কাছ থেকে পাক হানাদারদের দেখলাম। সঙ্গে রাজাকার ছিল, ছিল স্থানীয় দু’একজনও। বাজারে এক চক্কর দিয়ে তারা তাদের নৌকায় গিয়ে উঠলো, বড় নৌকা, আনুমানিক ৫০০ মণী। নৌকা বাজার থেকে ছেড়ে লাখাই থানা সদরের দিকে চলে গেলো। আরো একদিন ‘পাঞ্জাবী’রা এসেছিল ১৩টা ছোট আকারের গয়নার নৌকা নিয়ে। সময়টা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস, সেদিন তারা লাখাই থানা সদরের কাছাকাছি কৃষ্ণপুরের হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। কৃষ্ণপুর গ্রামে তারা একদিনে প্রায় দুই শতাধিক লোককে হত্যা করে। এতে করে পুরো লাখাই থানাজুড়েই এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
আমি আগেই বলেছি যে নানাবাড়িতে তখন ৬০/৭০ জন মানুষ। খাবার সময় এই সংখ্যা বিভিন্ন কারণে বেড়েই যেতো। প্রতিদিনই পথ চলতি মানুষ রাস্তার পাশের এই বড় বাড়িতে বিশ্রামের জন্য ও আশ্রয়ের জন্য উঠতো। বাড়ির লাগোয়া মসজিদ হওয়ায় প্রতি বেলাতেই মসজিদ থেকেও দু’একজন যোগ হয়ে যেতো। নানাবাড়ি ভাটি এলাকার সাধারণ মাপ অনুযায়ী বেশ বড় বাড়ি ছিল। পশ্চিম পাশে ১২০ ফিট লম্বা বড় ঘরের কথা আগেই বলেছি। এর দক্ষিণ পাশে ছিল টিউবওয়েল, পাকা গোসলখানা, প্রশ্রাবখানা ও আলাদা স্যানিটারি ল্যাট্রিন। পূর্ব ভিটায় দক্ষিণ পাশে বাংলা ঘর, চমৎকার কাঠের কাজে সমৃদ্ধ ছিল। সুন্দর ফিনিশিং ডাবল খুঁটি এবং উপরেও ডাবল বীম ছিল, কাঠের পাটাতনের সিলিং দেয়া। উত্তর পাশে মেঝ মামার ঘর। দক্ষিণ ভিটায় বড় মামার ঘর, ঘরের দক্ষিণ পাশে বড় পুকুর যা এখনো আছে। ফলে দখিনা বাতাসের কারণে এই দক্ষিণ ভিটার সবগুলো রুমই ছিল আকর্ষণীয়। উত্তর ভিটায় “কারি ঘর”, এখনকার সময়ে কোথাও চোখে পড়ে না। ‘কারি ঘর’ হলো ধানের গোলাঘর, ইটের খুঁটির উপর কাঠের খুঁটির ঘর, নীচে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, ৫০০+ মণ ধান রাখার ব্যবস্থা। মাঝখানে বড় উঠান। বাংলা ঘর ও মেঝ মামার ঘরের মাঝখান দিয়ে ভেতরের উঠানে প্রবেশের পথ যা বড় ঘরের মুখোমুখি। এটাও এক ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা। ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে ডাকাতি সাধারণ বিষয় তাই সুরক্ষার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ভেতরের উঠান সব সময় সরগরম থাকতো। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাতায়ত চলছেই, ৯/১০টা পরিবার, এতো বড় বাড়ি হলেও ঠাসাঠাসি। সিলেট থেকে আসা তিন পরিবার কুমিল্লা যাবার আগে দুই মাস ছিল আমাদের সঙ্গে। সন্ধ্যার পর বিশেষ করে ভেতরের উঠানে বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গা হয়ে যেতো, কখনো বাইরের উঠানে। এখন বাইরের উঠানটা নাই হয়ে গেছে, ভেতরের উঠানের আকারও পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলাঘরের সামনে একই সাইজের আরেকটা উঠান, উঠানের পূর্ব পাশে গোয়াল ঘর, এর পূর্ব পাশে গোবর রাখার ব্যবস্থা (গোফরের গাতা) ও “টাট্টি” এবং দক্ষিণ-পূর্বে বাড়ির ঘাটা বা প্রবেশ। বর্ষাকালে নৌকা বাড়ির ঘাটাতেই ভিড়তো, আর শুকনোর সময় নীচ থেকে হেঁটে ফুট দশেক উপরে উঠতে হতো। ঘাটাতে দুটো নৌকা সব সময়ই বাঁধা থাকতো, একটা ছইওয়ালা নৌকা যাকে আমরা বলতাম ‘গস্তি নাও’, আরেকটি ডিংগি নৌকা বা ঘাসের নাও। পাঞ্জাবী, রাজাকার বা ডাকাতের হামলার ভয়ে রাতে নিয়মিত পাহারা থাকতো।
আমার জেলার একটি অংশে, মাধবপুর-তেলিয়াপাড়া এলাকায় সারা বৎসরই পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ চলে। একবার ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একদল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা নানাবাড়িতে আসে। তাঁরা একদিন থেকে বিশ্রাম নিয়ে খেয়ে দেয়ে মাদনার দিকে চলে যায়। আর পাকবাহিনীর গানবোট নিয়মিতই মাইল তিন চারেক দূর দিয়ে যাতায়াত করে। একবার ১৩টি নৌকার এক বহর নিয়ে রাজাকারসহ পাকবাহিনী ঐ এলাকা অতিক্রম করে লাখাই যায়। ঘটনাক্রমে আমি ঐদিন লাখাই ছিলাম। পাকবাহিনী আসছে দূর থেকে দেখে আমরা প্রবল অনুকূল বাতাস ব্যবহার করে অন্যদিক ঘুরে বুল্লা ফিরে আসি। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ভারতীয় মিত্রবাহিনী আমাদের সমর্থনে যুদ্ধে লিপ্ত হয় ও সারাদেশে যৌথ বাহিনীর হামলা শুরু হয়।
আমাদের শহর পাকবাহিনীমুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর এবং তখন আমরাও শহরে ফিরে আসি। শহরের চারিদিকে অগ্নিসংযোগ আর লুটপাটের চিহ্ন। তখন সারাদেশেই বিভিন্ন মহকুমা জেলা পাক হানাদার মুক্ত হচ্ছিল। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে চারিদিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে ফেলে। উপায়ন্তর না দেখে ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হয় ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্থান লাভ করে। আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সবুজ পাসপোর্টের আধিকার লাভ করি।