ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
১৯৭৪ সাল। সিলেট সরকারি কলেজে (এমসি কলেজ) উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ি। ছাত্রাবাসের ৩য় ব্লকের সুপার ছিলেন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী স্যার। উনার মুল বাড়ি শায়েস্তাগঞ্জের দরিয়াপুরে, সে সূত্রে স্যার উনার তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য উনারই ব্লকে ১২নং রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অগোছালো পরিস্থিতিতে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। হোস্টেলের মাসিক খাবার খরচ ১২০ টাকা, যা নাকি এর মাস কয়েক পূর্বে মাত্র ৮০ টাকা ছিল। চতুর্দিকে কেমন যেন এক হাহাকার, হোস্টেলের খাওয়ার মান দিনদিন অনেক খারাপ হতে লাগল, পথেঘাটে ভিক্ষুকের মিছিল। বুঝা যায় হোস্টেল সদস্য প্রায় ছাত্রেরই মাসের শেষে বাবার পাঠানো সীমিত টাকা পয়সার কেমন জানি একরকম টানাপোড়েন চলছে।
আসল কথায় আসা যাক। দেশব্যাপী মন্বন্তর চললেও ভাটি অঞ্চলে তখন রমরমা সুখ। সকল কৃষক ও গৃহস্থের মুখে আনন্দের হাসি। সকল মাঝির মুখে লম্বা টান, মধুর সুরের পল্লীগীতি আর ভাটিয়ালী। পরনে সবার নুতন কাপড়, ভাগলপুরী সিল্কের লুঙ্গী, বাজারে নুতন আাসা টেট্রন কাপড়ের শার্ট, পাঞ্জাবী, হাতে নিদেনপক্ষে একটা কেমি ঘড়ি, ঘরে ঘরে রেডিও, অবস্থাভেদে কলেরগান বা প্রামোফোন। রাতে বিয়ের আসরে মাইকের আয়োজন থাকতেই হবে।
কারণ কিন্তু একটাই…
সোনালী ধানের সোনার দাম! এক মণ ধানের দাম তখন ২০০টাকার উপরে। এক হালি ডিম আট আনা তথা পঞ্চাশ পয়সারও কম, একটা মোরগ বড়জোর তিন চার টাকা, একটা মাঝারি বা বড় গরুর দাম বড়জোর এক হাজার টাকা। আজ আনুপাতিক হারে ধান ব্যতিত প্রতিটি জিনিসের মূল্য ১৯৭৪ সালের তুলনায় এখন প্রায় ১০০ গুণ, অনেক ক্ষেত্রে আরো বেশি। কিন্তু যদি আপনি ধানের দর হিসেব করেন এবং গুণিতক ১০০ হলে কমপক্ষে এখন হওয়া উচিত ২০০*১০০= ২০, ০০০ টাকা। হিসেবটা কষতে সত্যি বলছি আমারো খটকা লাগছে বৈ কি! এবং ১৯৭৫ সালে ধানের মণ ২৫০/২৭৫ এ উঠে গিয়েছিল।
তাই আবারো যা বলছিলাম, তখন এক মণ ধানের টাকা দিয়ে প্রায় দু’মাস অথবা দুই মণ ধানের টাকায় তিনমাস খুব সুন্দরভাবে হোস্টেলে চলতে পারতাম। আর এখন ২০ মণের টাকায়ও একজন হোস্টেল ছাত্রের একমাস চলে না।
সুতরাং ওই সময়ে একজন গৃহস্থ পরিবারের সদস্য হিসেবে হোস্টেল জীবনে আমার মত সুখী কয়জনই বা ছিল।
তাই বলছি.. যখন দুর্ভিক্ষের কারণে দেশব্যাপী এক হাহাকার পরিস্থিতি বিদ্যমান তখন ভাটি বাংলার গৃহস্থ তথা কৃষকশ্রেণী অন্যরকম সুখানন্দে বিভোর।
হ্যা আবারো বলছি, হয়ত মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষের কারণেই ধানের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছরে দ্রব্যমূল্য ১০০ গুণ বাড়লেও ধানের মূল্য ১০০ গুণ নয়, নিদেনপক্ষে ১০ গুণ বৃদ্ধি করেন তাহলে মণপ্রতি ২০০০ টাকা হওয়া উচিত। যদি ৫ গুণও বৃদ্ধি করেন তাহলে হবে মণপ্রতি ১০০০ টাকা। আপনি যেকোনভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন এর নীচে যদি ধানের বিক্রিত মূল্য হয় এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার কৃষক ঠিকবে না। গৃহস্থ পরিবার ক্রমশ বিলীন হতে বাধ্য। ভর্তুকি দিয়ে পারিবারিক ঐতিয্যকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায়না। সমাজ বিজ্ঞান বা সমাজ পরিবর্তনের ধারা তা বলেনা।
পলি বিধৌত বদ্বীপ এ দেশটা গড়ে উঠেছে কৃষিকে নির্ভর করেই। এ ধারা থেকে ছিটকে পড়লে তথা কৃষকগোষ্ঠী একবার বিমুখ হয়ে গেলে আবারো মন্বন্তর দুয়ারে কড়া নাড়তে বাধ্য। দিনমজুর পাওয়া যাবে, শ্রমিক পাওয়া যাবে, বহু সেক্টরে বিভিন্ন শ্রেণীর চাকর তথা চাকুরীজীবী পাবেন কিন্তু ঐতিহ্যের ধারক এ কৃষক পাবেন না। তেমনি করে গৃহস্থ পরিবারও ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকবে।
তাই বলছি কৃষক বাঁচান, গৃহস্থ পরিবার বাঁচান তথা সোনালী ফসল বাঁচান। তাহলেই আপনার আমার রক্তের দামে কেনা সোনার দেশটাও বাঁচবে।
চলবে…
ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
এমবিবিএস; এফসিপিএস
প্রাক্তন সিনিয়র কনসালটেন্ট
জাতীয় সংসদ সচিবালয়, ঢাকা।