মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা না থাকায় দলিত জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়েছে। দলিতদের দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞজন।
এ ব্যাপারে চুনারুঘাট নালুয়া চা বাগানের বাসিন্দা লিটন মুন্ড বলেন- দলিতদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। এক সময় তা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ। কিন্তু কালের আবর্তে তা হারাতে বসেছে। এজন্য তিনি অর্থনৈতিক দৈন্যতাকে দায়ী করেন। তার মতে আগেকার সময়ে জীবন নির্বাহ ব্যয় ছিল কম। ইলেক্ট্রনিক বিনোদন ছিল না বললেই চলে। তাই প্রত্যেকে নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করতো আপন মনে। অবসর সময়ে সবাই নিজস্ব সংস্কৃতি উপভোগ করতো। পরিবারের ব্যয় নির্বাহের পর সাংস্কৃতিক চর্চায়ও তারা অর্থ ব্যয় করতো উদার মনে। কিন্তু কালের আবর্তে সেই ধারায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন। কমে গেছে দলিত জনগোষ্ঠির আয় রোজগারের পথ। এখন জীবন নির্বাহ ব্যয় এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে পরিবার পরিজন নিয়ে দু’বেলা খেয়ে পরে থাকাই দায় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া সন্তানের লেখাপড়া ব্যয়তো আছেই। এ অবস্থায় তারা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অর্থ ব্যয় না করে জীবন নির্বাহে তা ব্যয় করছেন। দলিত জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে তিনি এ খাতে পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান। তা রাষ্ট্রীয়ই হোক অথবা ব্যক্তিগত পর্যায়েই হোক। যে পর্যায় থেকেই অর্থের সংস্থান হোক না কেন তা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যয় করা হলে আবারো প্রাণ ফিরে পাবে দলিতদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মী পার্থ সারথি রায় বলেন- দলিত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখন হুমকির মুখে। অর্থনৈতিক শক্তি না থাকলে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনেক ক্ষেত্রেই স্থবির হয়ে যায়। পূর্বে হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে হুলি উৎসব খুব জনপ্রিয় ছিল। কালের বিবর্তনে এবং অর্থনৈতিক কারণে ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হুলি উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। যদিও ভারতে কয়েকটি বড় উৎসবের মধ্যে হুলি একটি। অপরদিকে ঋষি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বিশেষত ঢাক বাজানোর এবং তৈরীর প্রবণতা ছিল। এখন নেহায়েতই দু’একটি পরিবার ছাড়া আর কেউ এই কাজে উৎসাহ বোধ করেন না। যদিও চা বাগানের শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে একত্রে থাকার ফলে তাদের মধ্যে এখনো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়। যেমন- কুসু, ফাগুয়া, রাসনৃত্য, কীর্ত্তনাদি, হুলি এগুলো এখনো টিকে আছে। তবে এখন সকলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তা এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বাড়ানোর জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অর্থব্যয় না করে তা ভিন্ন খাতে ব্যয়ের চেষ্টা করেন। তাছাড়া ইলেক্ট্রনিক বিনোদন হাতের মুঠোয় থাকায় অনেকেই নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। যে কারণে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির যে দীর্ঘ মেয়াদী ফল তা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম পুরনোদের কাছ থেকে এই ধারাবাহিকতা না পেয়ে নিজেরাও সংস্কৃতি বিমূখ হয়ে উঠছে। এখনই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া না হলে আস্তে আস্তে এই দীর্ঘ দিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো হারিয়ে যাবে এবং হয়তো আর এগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।