হবিগঞ্জের কিন্ডারগার্টেনগুলোর সাফল্যগাঁথা ১২

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করে নতুন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেছিলেন টগবগে তরুণ আলী মোহাম্মদ ইউসূফ। প্রতিষ্ঠানটিকে সাজাতে চেয়েছিলেন নিজের মতো করে। স্বপ্ন ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে পর্যায়ক্রমে কলেজে উন্নীত করা। এ স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। একটি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা তার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। অকালে তাকে হারিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিও আজ যেন শোকাহত। আর সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে শহরের আনোয়ারপুর আবাসিক এলাকায় (বাইপাস রোড) অবস্থিত লিটল ফ্লাওয়ার কেজি এন্ড হাই স্কুল।
স্কুলের বর্তমান প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মোঃ আব্দুল খালেক বলেন, ২০০৯ সালে কয়েকজন সমমনা এক হয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন ‘লিটল ফ্লাওয়ার কেজি এন্ড হাই স্কুল’। শহরের শ্মশানঘাট বাইপাস এলাকায় হবিগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পেয়ারা বেগমের বাসায় স্কুলটির যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার ৩ বছর পর ক্যাম্পাস পরিবর্তন করে আনোয়ারপুর আবাসিক এলাকায় (বাইপাস সড়ক) নিয়ে আসা হয়। শুরুতে ৭ জন মিলে প্রতিষ্ঠানটি চালু করলেও ক্যাম্পাস পরিবর্তনের সময় ৪ জন ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে তাদের মালিকানা হস্তান্তর করে চলে যান। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন মোঃ আব্দুল খালেক, ফরহাদ হোসেন টিটু ও আলী মোহাম্মদ ইউসূফ। আলী মোহাম্মদ ইউসূফকে স্কুলের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। আলী মোহাম্মদ ইউসূফ তার নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠানটিকে সাজানোর চেষ্টা করেন। স্কুলের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্কুলের এহেন কাজ নেই যা তিনি করেননি। তিনি কারো জন্য কোন কাজ ফেলে রাখেননি। তিনি দিনরাত স্কুলের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। তিনি চেয়ে ছিলেন স্কুলটিকে পর্যায়ক্রমে কলেজে উন্নীত করা। সেই লক্ষে তিনি সামনে এগুচ্ছিলেন। কিন্তু গত ১১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন। আর এর মধ্যদিয়ে আলী মোহাম্মদ ইউসূফের কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মোঃ আব্দুল খালেক বলেন, স্কুল ক্যাম্পাস স্থানান্তরিত হবার পর প্রতিষ্ঠানটি নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন আলী মোহাম্মদ ইউসূফ। স্কুলের প্রতিটি কাজ দরজা জানালা থেকে শুরু করে সবকিছু নিজে উপস্থিত থেকে কাজ করিয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে ৯ম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম শুরুর করার পরিকল্পনা ছিল। সেই লক্ষে আলী মোহাম্মদ ইউসূফ বইপত্রও স্কুলে নিয়ে আসেন। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল। সবকিছু উলট-পালট করে দিল। তিনি বলেন, আপাতত স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
২০০৯ সালে লিটল ফ্লাওয়ার কেজি এন্ড হাই স্কুল প্লে থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত ১শ’ ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। তখন শিক্ষক ছিলেন ৭ জন। বর্তমানে স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২শ’। আর শিক্ষক রয়েছেন ১২ জন। জানুয়ারি মাসে আরও ২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে প্লে থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) ও ৮ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় (জেএসসি) অংশ নিয়ে শতভাগ পাশ করেছে। যার আনুমানিক হার প্রাথমিকে ২৬০ জন আর ৮ম শ্রেণিতে প্রায় ৯০ জন।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মোঃ আব্দুল খালেক আরও বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। প্রায় প্রতি বছরই তাদের প্রতিষ্ঠানে ৭/৮ জন ফ্রি লেখাপড়া করছে। শত প্রতিকুলতা কাটিয়ে তারা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা চেষ্টা করবেন প্রয়াত অধ্যক্ষ আলী মোহাম্মদ ইউসূফের স্মৃতি ধরে রাখতে। তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। প্রতিষ্ঠানটিকে একটি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে রূপদিতে। এজন্য তিনি সকলের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।
লিটল ফ্লাওয়ার কেজি এন্ড হাই স্কুলে সপ্তাহের ৬ দিন শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সরকারি পাঠ্যপুস্তক বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি শিশুদের মেধার বিকাশ ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে চিত্রাংকন, সাধারণ জ্ঞান, সঙ্গীত, কম্পিউটার শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা ও হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয়। প্লে থেকে ২য় শ্রেণি পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা এবং ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আর সকাল সাড়ে ১১টায় একত্রে সকলের অংশগ্রহণে অ্যাসেম্বলী অনুষ্ঠিত হয়। স্কুল পরিচালকের দাবি, হবিগঞ্জ শহরে এমন নির্মল ও সুন্দর পরিবেশে অন্যকোন প্রতিষ্ঠান তার নজরে পড়েনি। কোন অভিভাবক তার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করলে এ প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাকে পড়াতে আগ্রহী হবেন বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদী।