ছানি বিশ^াস
হবিগঞ্জের জালালী কইতর, সুনামগঞ্জের কোড়া- সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া…। হবিগঞ্জের কৃতিসন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসের উপরিউক্ত গানটি হবিগঞ্জ জেলার নাম ছড়িয়ে দিয়েছে সীমান্তের ওপার বাংলাসহ বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে। ২২ নভেম্বর বাংলা গণসঙ্গীতের ¯্রষ্টা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি একাধারে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা, কবি, সুরকার, গীতিকার, গায়ক। ১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার মিরাশি গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হরকুমার বিশ্বাস ও মাতার নাম সরোজিনী বিশ্বাস। শিক্ষা জীবনের শুরুতে হবিগঞ্জ ইংলিশ মিডল স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করে ১৯৩০ সালে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গনিতসহ দুইটি বিষয়ে লেটার মার্ক পেয়ে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করেন। মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ (এমসি)। কলেজ জীবনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ায় কলেজ কর্তৃক বহিস্কৃত হন এবং ৬ মাস জেল খাটেন। এভাবে শিক্ষা জীবনের যবনিকাপাত ঘটিয়ে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ভারতের তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে জেল খাটেন তিন বছর। যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মুক্তি পেয়ে ১৯৩৮ সালে গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ গঠন করে আসাম ও বাংলার গণমানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। তার সাথে যুক্ত হয়ে সংগীতের মাধ্যমে গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন আসাম তথা ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী ভূপেন হাজারিকা। ১৯৩৯ সালে ৭ নভেম্বর স্বদেশী আন্দোলনের নেতা সুভাষ বসুর হবিগঞ্জে আগমন উপলক্ষে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় মানপত্র পাঠ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে বানিয়াচং থানায় ম্যালেরিয়া মহামারী আকার ধারণ করে মানুষ মারা গেলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলে সহায়তা করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন রচনা করেন ঢাকার গান। চিকিৎসার প্রয়োজনে চীনে গমন করলে মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি চীনেও ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগীতের মাধ্যমে আন্দোলন করে জনসাধারণের মন জয় করে নেন। ভারত- চীন মৈত্রী প্রতিষ্ঠার জন্য এক নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আসামে গড়ে তুলেন মাস সিঙ্গার্স নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন যা ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগীতের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি তার স্বীয় মেধা ও কর্মের মাধ্যমে গণমানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে হয়ে উঠেন গনসংগীতের প্রাণপুরুষ। তিনি আমৃত্যু ছিলেন শোষিত গণমানুষের বন্ধু। তিনি সংগীতের মাধ্যমে গণমুক্তির পথ খুজেঁ পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য গান হলো
১.আজাদী হয়নি আজো তোর, নব বন্ধন ও শৃঙ্খল ডোর…
২. তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান, কিষান ভাই তোর সোনার ধানে বর্গী নামে
৩. আমরা করবো জয় আমরা করবো জয় একদিন (ইংরেজি গানের অনুবাদ যা ভারতে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠে) আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এই গণসঙ্গীত ¯্রষ্টা ছিলেন গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ফলে হয়ে পড়েন পরিবার বিচ্ছিন্ন। নিজ জন্মভূমির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। তাই হবিগঞ্জ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তিনি বারবার সেখানে আসতেন এবং হবিগঞ্জকে নিয়ে লিখলেন ‘হবিগঞ্জের জালালি কইতর’ এবং খোয়াই নদীকে নিয়ে লেখা ‘তোমার কূলকে ভালোবেসেই তো কূল ছাড়া আমি, ব্রক্ষপুত্র আমার বিস্ময় পদ্মা আমার শ্রদ্ধা, গঙ্গা আমার ভক্তি তুমি আমার ভালোবাসা… খোয়াই’। তার বাংলা, অসমিয়া, চীনা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত গানগুলো সকলের কাছে জনপ্রিয়। ১৯৮৭ সালের ২২ নভেম্বর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা গনসংগীতের হারকিউলিকস ও প্রমিথিউস নামে পরিচিত কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস।