হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগ রাজনীতির প্রায় ৬৪ বছরের ইতিহাস নিয়ে লিখেছেন স্বনামধন্য সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট শাহ ফখরুজ্জামান। তাঁর এ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকায়। তাঁর এ লেখায় যদি কোন সংশোধন সংযোজন থাকে তাহলে সম্মানিত পাঠকবর্গ আমাদের কাছে লিখুন। আমরা আপনাদের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করব। বা.স.

শাহ ফখরুজ্জামান

প্রাকৃতিক ভূ-বৈচিত্র আর বহু বর্ণ, ধর্ম আর পেশার মানুষের বসবাসের জন্য হবিগঞ্জ একটি অনন্য জনপদ। অলি আউলিয়ার পূণ্য ভূমি এই জেলায় জন্ম নিয়েছেন অনেক সাধক আর গুণিজন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও দেশ বরেণ্য বহু বিখ্যাত ব্যক্তির জন্ম এই জেলায়। দেশের প্রতিটি অর্জনের ক্ষেত্রে সামনের সাড়িতেই ছিলেন এই জনপদের আলোকিত ব্যক্তিরা। রাজনৈতিক উত্থান পতনে হবিগঞ্জ জেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের বিকাশ ঘটলেও হবিগঞ্জকে বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘাটি। হবিগঞ্জকে ২য় গোপালগঞ্জ হিসাবেও চিহ্নিত করা হয় জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ভাল ফলাফল অর্জন এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত এর জন্য। তবে এই শক্ত ভিত একদিনে হয়নি। জেলার বিভিন্ন এলাকার দল অন্তপ্রাণ সংগঠকদের নিবেদন এবং ছাত্রলীগ থেকে সৃষ্টি হওয়া নেতা-কর্মীরা দলের নেতৃত্বে আসায় এই সু-সংহত অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠন থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ নামকরণ করা হয়। আওয়ামীলীগের চেতনার সাথে হবিগঞ্জের বহু শ্রেণী পেশার মানুষের মনের মিল থাকায় শুরু থেকেই এখানে আওয়ামীলীগের রাজনীতির চর্চা শুরু হয়ে যায়। তবে শুরুতে বাম রাজনীতি, পরে জাসদ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির আগ্রাসনে আওয়ামীলীগের চলার পথে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এর মাঝে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় আওয়ামীলীগের শীর্ষ পদে থাকা বেশ কয়েকজন নেতার আদর্শ বিচ্যুতি ঘটে। ফলে বিভিন্ন সময় ধাক্কা খেতে হয় আওয়ামীলীগের এই পথ চলায়। সারা দেশে মৌলবাদী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের উত্থান ঘটলেও আওয়ামীলীগের জন্য হবিগঞ্জে তারা ঘাটি করতে পারেনি। যদিও জামায়াত ও জঙ্গীবাদী সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ নেতার জন্ম এই জেলায় হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলায় আওয়ামীলীগ রাজনীতির সু-সংহত অবস্থান হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, তৃণমূল থেকে জেলা পর্যায়ে কাউন্সিল এবং ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরি এবং বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এখানে আওয়ামীলীগ সু-সংহত হয়েছে। এক সময় নেতারা মেধাবী এবং ভাল পরিবারের ছেলেদেরকে রাজনীতিতে টেনে আনতেন। এর ফলে ভাল নেতৃত্ব তৈরি হয়। সহযোগী সংগঠনগুলোর বিকাশ ঘটে বিশেষ করে ’৯০ এর দশকে বাম ঘরানার অনেক শীর্ষ নেতা আওয়ামীলীগে যোগদান করায় দলের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। সেই যোগদানের উদ্যোক্তা ছিলেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য এবং বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির এমপি। সেই সময়ে দলে যোগদানকারী সাবেক ন্যাপ নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান এমপি ধাপে ধাপে কৃষকলীগের সভাপতি, জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর বর্তমানে নির্বাচিত জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। সেই সময় যোগদানকারী সাবেক পৌর চেয়ারম্যান শহীদ উদ্দিন চৌধুরী বর্তমানে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য। সহযোগী সংগঠন ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের বর্তমান নেতাদের অধিকাংশই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। মূলত ৮০ এর দশকের সাবেক ছাত্রনেতা এবং ৯০ দশকের যোগদানের মেলবন্ধনে আওয়ামীলীগ বর্তমানে অত্যন্ত সু-সংহত অবস্থায় আছে। এর ফলাফল এসেছে ২০০২ এর জাতীয় নির্বাচন থেকে এখন পর্যন্ত কোন নির্বাচনেই নৌকার পরাজয় না হওয়া।
হবিগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আফরোজ বখত জানান, হবিগঞ্জে এক সময় আওয়ামীলীগ ও বামরাজনীতির মাঝে তুমুল প্রতিযোগিতা ছিল। আমাকে মহুকুমা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ আসনে আওয়ামীলীগ থেকে নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছিল। আমি আদর্শিক কারণে যাইনি। পরে গোপাল কৃষ্ণ মহারতœ সেখানে আওয়ামীলীগের এমপি হয়েছিলেন।
হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের প্রথম সভাপতি সৈয়দ সঈদ উদ্দিন আহমেদ পরবর্তিতে আদর্শচ্যুতি ঘটে অন্য দলে চলে যান। আরেক সাবেক সভাপতি কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীও শেষ জীবনে আওয়ামীলীগ থেকে চলে যান। সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমানও শেষ জীবনে মনোনয়ন না পাওয়ার অভিমানে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে দলের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তবে আমৃত্যু তিনি দল বদল করেননি।
তবে আওয়ামীলীগের সাবেক নেতা হিসাবে এখনও যাদের নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয় তাঁরা হলেন মুক্তিযুদ্ধের উপসর্বাধিনায়ক মরহুম মেজর জেনারেল এমএ রব, সাবেক গভর্ণর মরহুম অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী, মরহুম নিম্বর আলী তালুকদার, সাবেক এমপি মরহুম অ্যাডভোকেট শরীফ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক এমএনও মরহুম মাওলানা আছাদ আলী, সাবেক মন্ত্রী মরহুম এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, মরহুম ডা. সামছুল হোসেন উমদা মিয়া, অ্যাডভোকেট আকাদ্দছ আলী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইউনুছ চৌধুরী, আরজু মিয়া, জবান আলী, মশ^ব আলী, দিদার আলী, আজিজুর রহমান ছুরুক মিয়া, শাহ সুন্দর আলী প্রমূখ।
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া চাকুরী জীবন শেষ করে আওয়ামীলীগে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তিতে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ছিলেন। আরেক সাবেক কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রী মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সিলেট বিভাগে তিনি দলকে সুসংগঠিত করেন এবং সিলেট-১ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষ জীবনে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন জন্মস্থান হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে। এই আসনের সাবেক এমপি ইসমত আহমেদ চৌধুরী যদিও রাজনীতি করতেন সিলেটে কিন্তু তাঁর জন্মস্থান ছিল নবীগঞ্জে। প্রবাসেও হবিগঞ্জের অনেকেই আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে কাজ করেছেন।
হবিগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় গেলে এখনও দেখা যায় অনেক পুরনো মুরুব্বি যারা আওয়ামীলীগ ও বন্ধবন্ধুর চেতনাকে লালন করছেন। তবে তারা কোন পদলোভী নন। মূলত এই ধরনের ত্যাগী নেতাদের জন্যই এখনও তৃণমূলে শক্তিশালী সংগঠন আওয়ামীলীগ।

লেখক পরিচিতি
সাংবাদিক ও আইনজীবী
উপ-দপ্তর সম্পাদক হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগ