মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল

বদলে গেছে হবিগঞ্জ। ৫০ বছর আগের হবিগঞ্জের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান হবিগঞ্জের অনেক ফারাক। যোগাযোগ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে। সে সময়ের হবিগঞ্জের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে ছোট্ট পৌর এলাকায় জনসংখ্যা ছিল সীমিত। মোটামুটিভাবে সকলেই কম বেশি একে অপরের পরিচিত ছিলেন। যানবাহন বলতে ছিল মহকুমা প্রশাসনের ২/৩টি জীপ গাড়ী। মাইক্রোবাস, কার ছিল না। শহরে চলাচলের প্রধান বাহন ছিল প্যাডেল চালিত রিক্সা। মহকুমা সদরের সাথে বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই ও নবীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাঁচা সড়কগুলো ছিল দৈন্যদশাগ্রস্থ। ওই সড়কগুলো দিয়ে শরৎকালে কোনভাবে হালকা যানবাহন চলাচল করতে পারলেও বর্ষাকালে নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। তখনও ইঞ্জিন নৌকা আবিস্কৃত হয়নি। খোয়াই নদীর বিওসি ঘাট থেকে দেশী নৌকায় ঝালবাড়ী খাল দিয়ে বানিয়াচং, নবীগঞ্জ সহ বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যেত। তখনো কালারডোবা নৌকাঘাটের কোন পরিচিতি ছিল না। সড়ক পথে ঢাকা বা সিলেট যাওয়ার জন্য কোন বাস সার্ভিস ছিল না। ট্রেনে করেই যাওয়া আসা হত। তখন হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা ব্রাঞ্চ লাইনে ট্রেন চলাচল করত। আখাউড়া-সিলেট সেকশনে চলাচলকারী মেইল বা আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য ব্রাঞ্চ লাইনে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর উপর যাত্রীরা নির্ভরশীল ছিলেন। ওই সময় হবিগঞ্জ বাজার রেল স্টেশন থেকে সিলেট পর্যন্ত সরাসরি ট্রেন সার্ভিস ছিল। জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ঢাকা থেকে হবিগঞ্জে ট্রেনযোগে পাঠানো হত। বিশেষ করে “উল্কা” নামক ট্রেনে দুপুরে শায়েস্তাগঞ্জ জংশনে পত্রিকা পৌছার পর আবারো ট্রেন যোগে দুপুরে হবিগঞ্জ কোর্ট স্টেশনে পৌছাত। ওইদিনই অপরাহ্নে কিংবা পরদিন সকালে পত্রিকা পাঠকের হাতে পৌছাত। বর্তমান আলিফ হোটেলের স্থানে ছিল একটি পেট্রোল পাম্প ও অস্থায়ী বাসস্ট্যান্ড। পরে বাসস্ট্যান্ডটি জেকে এন্ড এইচকে হাই স্কুল সংলগ্ন স্থানে এবং বর্তমানে সুলতান মাহমুদপুর এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এর পূর্বে এক সময় বাসস্ট্যান্ড ছিল জজ কোর্টের প্রধান ফটকের সম্মুখস্থ সড়কের পাশে। ওই এলাকায় বেবী ট্যাক্সি রাখার কারণে বেবীস্ট্যান্ড নামকরণ করা হয়। বর্তমান কালেক্টরেট ভবনের স্থানে ছিল ব্রিটিশ আমলের নির্মিত মহকুমা প্রশাসকের বাসভবন। এর সামনে ছিল টেনিস কোর্ট ও বড় বাগান। বর্তমানে কালেক্টরেট ভবনের পূর্ব পাশে দুর্জয় হবিগঞ্জ স্মৃতিসৌধ, মেজর জেনারেল আব্দুর রব স্মৃতি পাঠাগার সংলগ্ন পূর্ব পাশে ছিল মূল খোয়াই নদী। ১৯৭৮-৭৯ সালে মাছুলিয়া থেকে রামপুর পর্যন্ত খোয়াই নদীর বাঁককাটার কারণে শহর থেকে নদী অনেকটা দূরে সরে গেছে। পূর্বতন নদীর কামড়াপুর, সিনেমা হল এবং স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় প্রতি বছর বাঁশের সেতু নির্মাণ করা হত। যা বন্যার পানির প্রবল ¯্রােতে ভেসে যেত। বর্তমানে খোয়াই নদীর পরিত্যক্ত অংশে জেলা পরিষদ ভবন যেখানে নির্মিত হয়েছে সেখানে ছিল নদীর গভীরতম অংশ। স্থানীয়ভাবে যা ‘ডর’ নামে পরিচিত। নদীতে বন্যা হলে আমরা থানার সামনে দাঁড়িয়ে নদীর প্রলয়ংকরী রূপ দেখতাম। নদীর পানির উচ্চতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট পাঠানো হতো। ৫০ বছর আগে ১৯৬৮ সালে আমি তখন বৃন্দাবন কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র। সবেমাত্র সাংবাদিকতা শুরু করেছি। তখন খোয়াই নদী সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতামত চাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই মহকুমা প্রশাসকের বাসভবন, কার্যালয়, কোর্ট, থানা, সার্কিট হাউজ সহ শহরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতো। ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের ব্যবহার না থাকায় তখন জরুরী সংবাদ মোর্স লাইনে টেলিগ্রাম করে সিলেট বা কুমিল্লা হয়ে ঢাকা পাঠানো হতো। টেলিগ্রামের মোর্স লাইন স্থানীয়ভাবে ‘টরেটক্কা’ নামে পরিচিত ছিল। সরাসরি ঢাকার সাথে হবিগঞ্জের টেলিফোন যোগাযোগ না থাকায় সিলেট বা কুমিল্লা হয়ে বহু কষ্টে ফোনে কথা বলা যেত। অধিকাংশ খবর পত্রিকা অফিসে ডাকযোগে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠানো হতো। তখন হবিগঞ্জ শহরের মিউনিসিপ্যাল মার্কেট বা সিনেমা হল বাজার ছিল জমজমাট। পৌরবাসী নিত্যদিনের কেনাকাটার জন্য এ বাজারের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। এখন সময়ের প্রয়োজনে পৌর এলাকার বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে অনেক বাজার ও মার্কেট। ওই সময়ে খোয়াই নদীর তীরে বিওসি ঘাটে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কার্তিক শাইল, নাগ্রা শাইল, পশুশাইল সহ বিভিন্ন জাতের চাউল এবং তাজা সবজি রাস্তার পাশে দাঁড়ালেই ক্রয় করা সম্ভব ছিল। চৌধুরী বাজারের নিকটে নারিকেল হাটায় ঢাকা থেকে পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা সরাসরি আসতো। তখন ট্রাক বা কার্গোর প্রচলন খুব একটা ছিল না। অনেক সময় ট্রেনে করে ও ব্যবসায়ীরা কিছু মালামাল আনতেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে জেলাবাসীর অর্ধেক জনসাধারণ ব্যবসা বাণিজ্য ও কেনাকাটার জন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার বাজার সমূহের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। হবিগঞ্জ মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের পাশে ছিল অঞ্জলী সিনেমা হল। বর্তমানে এর নাম মোহন সিনেমা হল। টেলিভিশন, ভিসিআর, কম্পিউটার না থাকার কারণে চিত্ত বিনোদনের জন্য মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা নিয়মিত সিনেমা দেখতে যেতেন। ওই সময় ভারতীয় বাংলা সিনেমার কদর ছিল বেশি। ইংলিশ সিনেমাও হলে দেখানো হত। নিউফিল্ডে কয়েক বছর পরপর কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য মেলায় প্রচুর দর্শক সমাগম হত। নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক ইত্যাদি পরিবেশনার কারণে টাউন হল এলাকা সকল সময়ই জমজমাট থাকত। পাশেই বর্তমান কাজী ম্যানশনের স্থানে বাঁশী ভাইয়ের ডাইলের বরার দোকান ছিল তরুণ সমাজের অন্যতম আকর্ষণস্থল। জালাল স্টেডিয়ামে ফুটবল মৌসুমে অনুষ্ঠিত হত বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। জাতীয় পর্যায়ের অনেক ফুটবল খেলোয়াড় এই মাঠে তাদের ক্রীড়া নৈপুন্য প্রদর্শন করে গেছেন। শীতকালে ক্রিকেট ও হকি খেলা হত। সিনেমা হল এলাকায় ছিল রাধাকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার সহ ৩/৪টি মিষ্টির দোকান। ভালো বেকারী ছিল না। শহরে খোশমহল, গুলবাগ, শাহবাগ, যামিনী হোটেল ছাড়া উন্নতমানের তেমন কোন হোটেল ছিল না। হবিগঞ্জের বাইরের কোন অতিথি আসলে শহরে দেখাবার মত প্রতিষ্ঠান ছিল টাউন হল সড়কে অবস্থিত বর্তমান মধুবন হোটেল ভবনে স্থাপিত পূর্বতন মিউনিসিপ্যাল পাবলিক লাইব্রেরী। এর নিবেদিতপ্রাণ সম্পাদক মরহুম বদিউজ্জামান খান এর সুন্দর পরিচালনায় সারা দেশে এ লাইব্রেরী প্রশংসিত ছিল। বর্তমানে শহরের রাজনগর এলাকায় বিয়াম স্কুল, শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তন এলাকা ছিল মহকুমা কারাগারের নিজস্ব ভূমি। শীত মৌসুমে এই ভূমিতে কারাগারের কয়েদীদেরকে দিয়ে জমিতে শাক-সবজি চাষ করানোর দৃশ্য প্রায়ই নজরে পড়তো। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্বপার্শ্বস্থ তিনকোনা পুকুরে ছিল লাল শাপলা ফুলের সমারোহ।
ক্রীড়া সংস্থার অফিস সংলগ্ন বর্তমান টেনিস কোর্ট পরিচিত ছিল ঐতিহাসিক শিরিষ তলা হিসেবে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের জন্য শিরিষ তলা ছিল আদর্শ স্থান। মুসলিম কোয়ার্টার এলাকায় অবস্থিত চিলড্রেন পার্কেও সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হত। জজ কোর্টের উত্তর পাশের বর্তমানে দেয়াল ঘেরা পুকুর যা ট্যাংক নামে পরিচিত ছিল। এর চারপারে প্রতিদিন বিকেল বেলা দর্শনার্থীরা ভিড় জমাতেন। পুকুরের মাঝামাঝি উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি প্ল্যাটফরম ছিল। লোহার পিলারের উপর পাকা পাটাতন দেখতে ছিল অনেকটা ব্রীজের মত। এগুলোর উপর কিশোর-যুবকেরা উঠে পুকুরের পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে সাতার কাটার দৃশ্য অনেকেই উপভোগ করতেন। বর্তমান রামকৃষ্ণ মিশনের উত্তর দিকে এখন কাপড়ের বড় ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে ওঠেছে। ৫০ বছর আগে ওই এলাকা পরিচিত ছিল কাঠপট্টি হিসেবে। সেখানে কোন কাপড়ের দোকান ছিল না। শুধুই ছিল স্থানীয়ভাবে তৈরি কাঠের তৈরি ফার্নিচারের দোকান। সেই সময়ে আলমশেঠ, কদ্দুছ খান, ঈশ্বরপালের ছিল বড় কাপড়ের দোকান। বর্তমান পত্রিকার এজেন্ট বিশ্ববার্তার উত্তর পাশে ছিল কয়েকটি তৈরি পোষাকের দোকান। তখনো দর্জির দোকানে চাহিদামত পোষাক তৈরি হত। রেডিমেইড গার্মেন্টসের তেমন কোন প্রচলন ছিল না। বর্তমানে ব্যস্ত শশ্মানঘাট সড়কের দৃশ্য দেখলে মনে পড়ে এক সময়ে শশ্মানঘাটের সরু রাস্তা দিয়ে কেবলমাত্র মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কেউ ওই রাস্তায় যেত না। এমনকি ওইদিকে তাকাতেও অনেকে ভয় পেত। ভোর বেলা শহরের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য ছিল মহিষে টানা ময়লার গাড়ী। তখন পৌর এলাকার অধিকাংশ বাড়ীঘরে ছিল কাঁচা লেট্রিন। ভোর রাতে লেট্রিনের ময়লা পরিস্কার করে পৌরসভার কর্মচারীরা তা ময়লার গাড়ীতে করে শহরের বাইরে বর্তমান বাসস্ট্যান্ড এর নিকটস্থ নির্ধারিত স্থানে নিয়ে ফেলত। এই ময়লার গাড়ীর চাকার ঘড়, ঘড় শব্দ ও দুর্গন্ধে পথচারীদের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দৌঁড়ে যাওয়ার দৃশ্য এখনো অনেকের মনে পড়ে। ওই সময় শহরে কোন প্রাইভেট ক্লিনিক, শিক্ষার্থীদের জন্য কোচিং সেন্টার, কেজি স্কুল ছিল না। এসএসসি পরীক্ষার একমাত্র কেন্দ্র ছিল মহকুমা সদর হবিগঞ্জে। এ কারণে মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষা দেয়ার জন্য আত্মীয় স্বজনদের বাসা বা মেসে এসে উঠতেন। তখনকার সময়ে বৃন্দাবন কলেজে ছাত্র-রাজনীতি ছিল উল্লেখযোগ্য। মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক কারণে ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ হত। কিন্তু সকল দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্ক থাকায় বিরোধ কোন সময়ই মারাত্মক সহিংসতায় পরিণত হত না।
দীর্ঘ ৫০ বছরের পরিক্রমায় বদলে গেছে হবিগঞ্জ। দুই রাস্তার পাজামার মত শহর কিংবা অসংখ্য পুকুরের শহর এ নামে এখন আর হবিগঞ্জ পরিচিত নয়। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্পক্ষেত্রে হয়েছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। একেই সাথে বেড়েছে হবিগঞ্জ পৌর এলাকার পরিধি ও জনসংখ্যা। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সমস্যা সমাধানের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। নাগরিকদের প্রত্যাশা আগামী প্রজন্ম সর্বক্ষেত্রে হবিগঞ্জকে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল
এম.এ, এল.এল.বি, এডভোকেট
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব