রুমা মোদক

উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, সংস্কৃতি শব্দের আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। ইংরেজি পঁষঃঁৎব শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবে সংস্কৃতি শব্দটি বাংলায় এসেছে।
কোনস্থানের মানুষের আচার ব্যবহার রীতিনীত, জীবিকার উপায় সঙ্গীত নৃত্য সাহিত্য নৃত্যকলা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষা দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয় তাই সংস্কৃতি।
মানুষের সংস্কৃতিকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রতিটি সমাজের মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত যে বিষয় তাও মানুষের সংস্কৃতি। আবার জীবন উপভোগের ব্যবস্থা ও উপকরণের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ও সংস্কৃতি।
আমরা মূলত আলোচনা করবো জীবন উপভোগের ব্যবস্থা আর উপকরণের সাথে সম্পর্কিত বিষয় যে সংস্কৃতি তা নিয়ে এবং তার প্রেক্ষিত ও পটভূমি বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যন্ত এক জেলা হবিগঞ্জ।
হবিগঞ্জ কেবলই শহর নয়। একটি জেলা। ৯টি উপজেলা, কয়েকশো গ্রাম, আর তার অধিবাসী। কেমন চলছে এর সংস্কৃতি চর্চা, কেমন ছিলো এর অতীত।
আমাদের এক স্বাভাবিক প্রবণতা ‘আহা’ বলা অর্থাৎ আমরা যে যে সময়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, তখন কেবলই আফসোস করা। আমরা যখন কাজ করেছিলাম, আহা তখন! এক কথায় নিজেদের অবস্থান পরবর্তী সময়কে গুরুত্ব না দেয়ার এক সংকীর্ণ মানসিকতা আমাদের পরবর্তী চর্চাকে না দেয় স্বীকৃতি না দেয় পৃষ্ঠপোষকতা।
এ আমার আক্ষেপের কথা। আমি কিংবা আমরা যারা ত্রিশ বছর কিংবা তারো অধিক সময় ধরে এই শহরের সংস্কৃতি চর্চার সাথে মিশে আছি, কিংবা লেগে আছি একাত্ম হয়ে, আমরা এ শহরের অনেক সাংস্কৃতিক বিকাশ উত্থান ও পতনের সাক্ষী। আমরা দেখেছি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কী করে একটি জেলা শহর পত্রে পুষ্পে কুসুমিত হয়ে উঠে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধে সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে। আমরা দেখেছি কী কিরে তৈলবাজদের হাতে সংস্কৃতি তার মহিমা হারিয়ে কেবলই অর্থহীন চর্চায় পর্যবসিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকার নিজস্ব সংস্কৃতি আর তার নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। যা তাকে পৌছে দেয় জাতীয় পরিমন্ডল পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। আমাদের প্রথমেই উপলব্ধি করতে হবে কী হবে আমাদের সংস্কৃতি চর্চার উদ্দেশ্য। নিজ নিজ এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে তাকে জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতিনিধিত্বশীল করে তোলা নাকি কেবলই নিজ এলাকার ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতায় সীমিত থেকে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলা।
একজন হাসন রাজা, একজন বাউল করিম একজন শেখ ভানু যখন নিজের এলাকার সীমানা অতিক্রম করে দেশ জাতির কাছে পৌছেছেন, হয়ে উঠেছেন দেশের সম্পদ তখন তাদের জন্মস্থান ও সংস্কৃতিচর্চার শুরুর ক্ষেত্রটুকু হয়ে উঠেছে তীর্থস্থান। যে বিশেষ স্থানে জন্ম ও বর্ধিত হওয়া সেই শিকড় সংশ্লিষ্ট থেকে নিজের ডালপালা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার মাঝেই কৃতকর্মের সার্থকতা।
আমরা প্রায়শই এই সার্থকতা অনুধাবন করতে পারি না। সংস্কৃতিচর্চা হয়ে উঠে আমাদের নেহাৎ বিনোদন কিংবা সময় কাটানোর উপলক্ষ কিংবা আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। আমরা যে সমাজ বাস্তবতায় বাস করি সেই সমাজ বাস্তবতায় সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে নিজের দায় এবং দায়িত্ব অস্বীকার করার মানে জাতির পায়ে কুড়াল মারা। একটি জাতির সৃমদ্ধ ভবিষ্যৎ তৈরির সম্ভাবনা নষ্ট করা।
বলা বাহুল্য আমরা যে একটি দায় দায়িত্বহীন আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম পেয়েছি, চলছি এক স্বপ্নহীন লক্ষহীন এক গন্তব্য অভিমুখী যাত্রায়, এই যে জঙ্গিবাদ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান তার সবকিছুর মূলে সাংস্কৃতিক বিকাশের অভাব। আমাদের আমজনতার ধারণা মঞ্চে উঠে দুটো গান গাওয়া মানে সাংস্কৃতিক চর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চা মানে নিজে একজন শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা পাওয়া। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিকাশ মানে একটি জাতিগোষ্ঠীর সামগ্রিক মানসিক বিকাশ যা একটি জাতিকে কখনোই পশ্চাৎপদ হতে দেয় না।
সেদিক থেকে কেমন হবিগঞ্জের সাংস্কৃতিক চর্চার অবস্থা? বর্তমান থেকেই শুরু করি। একটি শহরের সাংস্কৃতিক চর্চা মূলত দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়। একটি রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা সমৃদ্ধ। গণমানুষের সাথে যার কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও চলে। সরকারের গুণকীর্তন আর নির্দোষ চর্চাতেই এই প্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ। এদের কাছে প্রত্যাশা নেই। এরা আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মপ্রচারে মগ্ন।
কিন্তু মূল সাংস্কৃতিক কর্মী তারা যারা দায়বদ্ধতায় সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখে। তারা নিজেদের মেধা ও প্রতিভাকে নিয়োজিত রাখে দেশ ও জাতির মঙ্গলার্থে। মূলত এরাই সংস্কৃতির আসল নিয়ামক। যারা নিজের এলাকাকে তুলে ধরে অন্য উচ্চতায়। যাদের কর্মকান্ড জাতির অগ্রগতির ইতিহাসের সমান্তরালে চলে। সমকালে যাদের নামে পরিচিত হয় স্ব কাল, স্ব স্থান।
হবিগঞ্জ কখনোই সাংস্কৃতিক চর্চায় বন্ধ্যা ছিলো না।
নানা লোকসংস্কৃতি আর আরবান সংস্কৃতির মিশ্রণে এক সমৃদ্ধ জনপদ এই হবিগঞ্জ। কেমন চলছে এই শহরের সাংস্কৃতিক চর্চা এখন?
সাংস্কৃতিক চর্চার মূল কেন্দ্রগুলো যে মিলনায়তন, হবিগঞ্জে দীর্ঘদিন প্রায় সবকটি হল অচল, অকেজো। নিয়মিত চর্চার জন্য কোন মঞ্চ নেই। এই শহরে রয়েছে কিবরিয়া মিলনায়তনের মতো একটি অত্যাধুনিক হল। যা দেশের অন্য দশটি জেলার ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠতে পারত। অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, সেন্ট্রালি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এরকম হল খোদ ঢাকাতেই শিল্পকলা ছাড়া আর নেই। এরকম একটি হল যে শহরে আছে, সেই শহরে হলকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক চর্চার জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা। শুরুতে হয়েও ছিলো তাই। যে কোন জোয়ারের একটি নিয়ামক প্রয়োজন হয়। হলটি হয়ে উঠেছিলো শহরের সাংস্কৃতিক চর্চার নিয়ামক। নতুন নতুন উদ্যোগে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের শিল্পীদের পদচারণায় মুখর থাকতো এই হল। কিন্তু কোন অজানা কারণে এটিকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে সাংস্কৃতিক চর্চার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে কত অবলীলায়।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একমাত্র টাউনহল, একসময় নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে জমে থাকতো মাসজুড়ে। এই হল থেকেই জন্ম নিয়েছেন একজন সুবীর নন্দী, ঝুনা চৌধুরীর মতো শিল্পীরা। শহরের মূল সড়ক ধরে হেঁটে গেলে এমন দিন নেই, এর ভেতর থেকে খোল করতাল হারমোনিয়ামের সুরে মেতে উঠতো না শহরের রাজপথ। চোখের সামনে স্তব্ধ হয়ে গেলো সেটি। সংস্কারের ফলে এটি এখন সাইফুর রহমান মিলনায়তন, যে কোন সাংস্কৃতিক আয়োজনের সম্পূর্ণ অযোগ্য একটি হল। এই হলটি ঘিরে আর কোন সাংস্কৃতিক আয়োজনের সাড়া পাওয়া যায় না।
হবিগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির হলটি বিশাল বাজেটে নির্মিত হলেও সেটির কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। যৎসামান্য যা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ এই হলটিকে কেন্দ্র করে চলমান ছিলো। বর্তমানে তাও বন্ধ আছে সংস্কার কাজের জন্য।
জীর্ণ ভগ্নদশায় শহরের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে আছে আরডি হল। এটি কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একেবারেই অনুপযোগী। দখল করে আছে ব্যক্তি পর্যায়ের নানা প্রতিষ্ঠান। এখানে নানা বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হয়, কিন্তু আদতে কজন প্রতিনিধিত্বশীল শিল্পী বের হয়েছে তার হিসাব কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
যে শহরে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার কোন স্থান নেই, কোন পৃষ্ঠপোষকতা তো নেই ই সেখানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
আমি শুধু ভূমিকাটুকুতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলাম আজ। আশা করি আগামীতে অতীতের নিরিখে বর্তমান ও ভবিষ্যতের অবস্থা, প্রবণতা ও প্রাপ্তি নিয়ে কথা বলার অবকাশ পাবো।