ধানের মতো পোল্ট্রি মোরগের বিক্রয় মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ॥ ক্ষতির শিকার হয়ে অনেক ব্যবসায়ী খামার বন্ধ করে দিয়েছেন

এসএম সুরুজ আলী ॥ একদিকে অস্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থা, পোল্ট্রি খাদ্য, ওষুধ ও বাচ্চার দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি অপরদিকে উৎপাদিত মোরগের দাম কম হওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হবিগঞ্জের পোল্ট্রি শিল্প। ইতো-মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে জেলা অধিকাংশ পোল্ট্রি খামার। দীর্ঘদিন ধরে হবিগঞ্জ জেলার খামারীরা পোল্ট্রি মোরগের খাদ্য, ঔষধ, বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণে আনার আন্দোলন করে আসলেও এর কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না। দিন দিন লোকসান গুনতে গুনতে অনেক খামারী এখন এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই বেকার জীবন যাপন করছেন। তবে বাজার মনিটরিং করে সরকার পোল্ট্রি শিল্পের উপর সঠিক নজরদারী করলে এ শিল্পকে রক্ষা করা যাবে বলে জানিয়েছেন পোল্ট্রি খামারী ও ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে হবিগঞ্জের পোল্ট্রি খামারী ও ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলায় ছোট বড় প্রায় ৬ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। ২/৩ মাস ধরে গরমের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খামারে মোরগগুলো মরে গিয়ে একদিকে যেমন খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে মোরগের খাদ্য, ঔষধ ও বাচ্চার দাম বেশি হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত (১ম পৃষ্ঠার পর)
হচ্ছেন খামারীরা। গত এপ্রিল মাসে প্রতি বস্তা খাদ্যের দাম ছিল ২ হাজার ২৭৫ টাকা থেকে ২ হাজার ৩শ’ টাকা। মোরগের বাচ্চার দাম ছিল ৮০/৮৫ টাকা। এক মাসে প্রতিটি মোরগকে আড়াই কেজি খাবার খাওয়াতে হয়। খাদ্য ঔষধসহ ইলেকট্রিক ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে প্রতিটি মোরগের উৎপাদন খরচ হয় ১৪০ টাকা টাকা। এর সাথে বাচ্চার মূল্য যোগ করলে ২২০/২২৫টাকা খরচ হয়। এক মাস খাদ্য খাওয়ানোর পর প্রতিটি মোরগ ১কেজি ৪শ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৫শ গ্রাম ওজন হয়। এছাড়াও কোন কোন মোরগের ওজন সর্বোচ্চ ১ কেজি ৬শ গ্রাম কিংবা কেজি ৭শ গ্রামও হয়ে থাকে। প্রতি কেজি মোরগ বিক্রি করতে হয়েছে ১২০ টাকা দামে। এ হিসেবে প্রতিটি মোরগের দাম পড়ে ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা। এতে গড়ে প্রতি কেজিতে খামারীদের লোকসান হচ্ছে ৪০/৪৫টাকা। এছাড়াও সময়ে সময়ে বাজারের মোরগের দাম পরিবর্তন হচ্ছে। মে মাসে বাজারে খাদ্যের দাম কিছুটা কমে ২ হাজার ৫০ টাকা থেকে ২ হাজার ৭৫ টাকা হয়েছে। বাচ্চার দামও অনেকটা কমেছে। প্রতিটি বাচ্চা পাইকারী ১৪/১৫ ও খুচরা বাচ্চা ১৮/২০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতিটি মোরগের বাচ্চার দামসহ উৎপাদন খরচ ১২৬/১৩০টাকা হয়। বর্তমান খামারে প্রতি কেজি মোরগ ৯৫/৯৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে ১০০/১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারী দামে বিক্রি করে প্রতি কেজি ৩০/৩৫ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে খামারীদের। এ অবস্থায় প্রতি মাসেই লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারীদের। এছাড়াও খামারীরা সরকারিভাবে ভ্যাকসিনসহ কোন ঔষধ পাননি বলে জানিয়েছেন।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার গজারিয়াকান্দি গ্রামের পোল্ট্রি মোরগের খামারী সাবেক মেম্বার নুরুল ইসলাম জানান, অনেকটা আশা নিয়ে ব্রয়লার (পোল্ট্রি) মোরগের খামার করেছিলাম। গত মাসে খামারে ৯শ মোরগের বাচ্চা তুলেছিলাম। শনিবার মোরগগুলোর পাইকারী দাম হয়েছে ৯৫/৯৬টাকা। এ হিসেবে মোরগ বিক্রি করলে আমার ৪৫হাজার টাকা লোকসান হয়। তিনি বলেন- সরকারীভাবে ভ্যাকসিন কিংবা ঔষধ পেলে হয়তো আরও কম লোকসান হতো। সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, ক্ষতিগ্রস্ত খামারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য ব্যাংক লোন প্রদানসহ ভ্যাকসিন অন্যান্য ঔষধগুলো দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে তিনি মোরগ তুলবেন কি না এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। তবে এ গ্রামের আরো দুয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খামার বন্ধ করে রেখেছেন। হবিগঞ্জ শহরের বানিয়াচঙ্গ সিএনজি স্ট্যান্ড হক পোল্ট্রি ফার্মের স্বত্ত্বাধিকারী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামছুল হক জানান, দীর্ঘদিন ধরে পাইকারী ও খুচরা পোল্ট্রি এবং লেয়ার মোরগ বিক্রি করলেও এবার অনেকটা শখের বসে মোরগের খামার করেছিলাম। এপ্রিল মাসে খামারে ৩হাজার মোরগ তুলেছিলাম। মে মাসে বিক্রির পর সব খরচ বাদ দিয়ে ৭০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। এরপর তিনি এ মাসে আবারও মোরগ তোলার চেষ্টা করছেন।
সিলেট খামার রক্ষা কমিটির সভাপতি ও হবিগঞ্জ জেলা পোল্ট্রি খামার মালিক সমিতির সভাপতি কয়সর আহমেদ শামীম জানান, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বেকিটেকা গ্রামে তার ৪টি পোল্ট্রি মোরগের খামার রয়েছে। সেখানে তিনি প্রতি মাসে ১০ হাজার ব্রয়লার (পোল্ট্রি) মোরগ ও ৪হাজার লেয়ার মোরগ তুলতেন। গত দু’মাস অতিরিক্ত গরমের কারণে মোরগ মরে গিয়ে ২০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এরপর আমার পোল্ট্রি খামারগুলো বন্ধ রয়েছে। এখন সেখানে অন্য ব্যবসার চিন্তা করছি। তার এই ক্ষতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন খাদ্য, ঔষধের উচ্চ মূল্য, কোম্পানীগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা। যে কারণে জেলার ৬হাজার খামারীর মধ্যে অধিকাংশ খামারী খামারগুলো বন্ধ রেখেছেন। খামারীরা এখন অন্য পেশায় যাওয়ার জন্য তার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু শূন্য অবস্থায় খামারীরা কিভাবে অন্য পেশায় যাবেন। তিনি বলেন- দীর্ঘদিন ধরে খামার রক্ষার আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু এর কোন প্রতিকার পাইনি। অথচ পাশ^বর্তী দেশ ভারতে পোল্ট্রি বাজারজাত করণের লক্ষ্যে পোল্ট্রি বিডার এসোসিয়েশন ও উভয় পক্ষের সমন্বয় রেখে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বার্ষিক বাচ্চার নির্ধারণ করে ক্যালেন্ডার তৈরী করা হয়। যাতে বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে থাকে। যাতে খামারীরা লাভবান হতে পারেন। বাংলাদেশের মধ্যে আমরা হবিগঞ্জ জেলা পোল্ট্রি খামার মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ অতীতে বাচ্চার দাম সরকারিভাবে ৩০টাকা রাখার জন্য আন্দোলন করেছি। বর্তমানেও আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লাখ লোক পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত। বার বার লোকসানের কারণে তাদের রোজী রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পোল্ট্রি খামার রক্ষায় সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, হ্যাচারী মালিকদের সাথে আলোচনা করে এ বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তিনি এ শিল্পকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যথায় দেশে পোল্ট্রি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
হবিগঞ্জ জেলা পোল্ট্রি ডিলার সমিতির সভাপতি এমএ মতিন জানান, এক সময় হবিগঞ্জের পোল্ট্রি শিল্পের অনেকটা ঐতিহ্য ছিল। এ শিল্পের সাথে শিক্ষিত বেকার যুবকরা জড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু পোল্ট্রি খাদ্য, ঔষধ, বাচ্চাসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যদি খাদ্য ও ঔষধের দামের পাশাপাশি মোরগের দাম বৃদ্ধি করা হতো তাহলে খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন না। খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে ফিড মালিক ও হ্যাচারী মালিকদের সাথে সরকারিভাবে আলাপ-আলোচনা করে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারিভাবে ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য ঔষধ পেলে এ শিল্পকে রক্ষা করা যাবে।
খামারী সূত্র জানায়, প্রতি মাসে খামারে ৩ বার ভ্যাকসিন দিতে হয়। এজন্য প্রতি মাসেই জেলায় রানীক্ষেত, কলেরা, ফক্সসহ বিভিন্ন ধরণের ভ্যাকসিনসহ ঔষধ জেলা পশু হাসপাতাল (প্রাণিসম্পদ) কর্মকর্তার কার্যালয়ে সরকারি মূল্যে বিক্রির জন্য আসে। কিন্তু সেগুলো উপজেলা পশু হাসপাতালগুলোতে গেলে অতিরিক্ত মূল্যে বিভিন্ন পশুর ঔষধ বিক্রির দোকানে বিক্রি করে দেয়া হয়। যে কারণে খামারীরা পশু হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন পান না বলে অভিযোগ করেছেন। খামারীরা বিভিন্নভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ ওয়াহিদুল আলম শাহীন জানান, হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রায় ৫০টি পোল্ট্রি মোরগের খামার ছিল। কিন্তু খাদ্য, বাচ্চা, ঔষধসহ অন্যান্য উপকরণের দাম ও মোরগের দাম কমে যাওয়ার কারণে খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বর্তমানে হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় হাতেগোনা কয়েকটি খামার রয়েছে। অধিকাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন- আমাদের এখানে যেসব ভ্যাকসিন আসে সেগুলো খামারী ও যারা পশু লালন-পালন করেন তারা সরকারি মূল্যে নিয়ে যান। আমার এখানে ভ্যাটেনারী সার্জন থাকার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাটেনারী সার্জন না থাকার কারণে পশুদের সেভাবে সেবা প্রদান করা যাচ্ছে না। অবিলম্বে একজন ভ্যাটেনারী সার্জন নিয়োগের জন্য তিনি দাবি জানান। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ডিএলও) প্রকাশ রঞ্জন বিশ^াস জানান, ব্রয়লার (পোল্ট্রি) খামারের বাচ্চার দাম উঠানামা, খাদ্যের দাম বেশি হওয়ার কারণে মোরগের উৎপাদন খরচ বেশি হয়। অপরদিকে বাজারে মোরগের মূল্য কম হওয়ার কারণে খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে কেন্দ্রীয়ভাবে খাদ্য ও বাচ্চার দাম নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। তিনি বলেন- আমার এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন আসে। সেগুলো নিয়মমতো বিতরণ করা হয়।