বিভিন্ন পরীক্ষার বেড়াজালে পড়ে বছরের প্রায় ৯ মাসই ক্লাস হয় না ॥ প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্রীর জন্য ৩৪ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র ২১ জন ॥ একজন সহকারী অধ্যাপকসহ ১৩টি প্রভাষকের পদ শূন্য রয়েছে

এসএম সুরুজ আলী ॥ শিক্ষক সংকট, কর্মচারী সংকট, অবকাঠামো সমস্যাসহ নানা সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়েছে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ। এ কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ঘটছে ফল বিপর্যয়ও। কলেজ কর্তৃপক্ষ এ সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করলেও এর কোন সমাধান পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় তাদের পাঠদান চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এছাড়াও কলেজে বছরের ৬ মাস বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষাসহ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাতো থাকছেই। এসব পরীক্ষার কারণেও কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় ৩ মাস কলেজের ছাত্রীরা ক্লাস করতে পারছেন। আর বাকী ৯ মাস অলসভাবে কাটিয়ে তাদের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ১৯৮৫ সালে শহরের রাজনগর এলাকায় মাত্র ১.০৫ একর ভূমিতে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছরের ১ নভেম্বর মাত্র ১৮ জন ছাত্রী নিয়ে জেলা গণগ্রন্থাগার ভবনে প্রথম পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন- তৎকালীন উপবিভাগীয় কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার, হবিগঞ্জের প্রথম জেলা প্রশাসক শাহ মুহাম্মদ নাজমুল আলম, সাবেক জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফরাসউদ্দিন।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ১৮টি কলেজ জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ৫ এপ্রিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান মরহুম শাহ এ.এম.এস কবরিয়ায় সহযোগিতায় কলেজটি সরকারিকরণ করা হয়। কলেজে বর্তমান ছাত্রীর সংখ্যা ৩হাজার ৩শ এর অধিক। কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ বাদে শিক্ষকের সৃষ্ট পদ সংখ্যা ৩৪টি থাকলেও বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ২১ জন। ১ জন সহকারী অধ্যাপকসহ ১৩টি প্রভাষকের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, দর্শন, ইসলামের ইতিহাস, পদার্থ বিজ্ঞানে ১জন করে প্রভাষক শূন্য রয়েছে। রসায়নের সহকারি অধ্যাপক পদটি শূন্য রয়েছে। এ পদের প্রভাষক দীর্ঘদিন ধরে নেই। প্রাণিবিদ্যা, ব্যবস্থাপনা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পদটিও শূন্য রয়েছে। শিক্ষক-সংকটের কারণে ছাত্রীরা ফল খারাপ করছে। কলেজটিতে ২০১৮ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৭৫ দশমিক ৫৭, ২০১৯ সালে ৭২ দশমিক ১৯ শতাংশ। অপরদিকে, প্রয়োজনীয় জমির অভাবে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার মাঠ নেই। বিভিন্ন উৎসব ও প্রতিযোগিতায় কলেজ সংলগ্ন হবিগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠটি পূর্বানুমতি নিয়ে ব্যবহার করতে হয়।
৬ মাসই পরীক্ষা ঃ হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজটি একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বছরের ১২ মাসের মধ্যে এ কলেজে গড়ে ৬ মাসেই পরীক্ষা থাকে। বাকি ৬ মাসের মধ্যে সাপ্তাহিক ও বিভিন্ন সরকারি ছুটির কারণে গড়ে ৩ মাসও পরিপূর্ণ ক্লাস হয় না। সরকারি নীতিমালার কারণে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের অনার্স ও ডিগ্রির সব পরীক্ষা হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে, এ কলেজের ছাত্রীরা নিয়মিত পাঠগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হন।
ছাত্রী ও শিক্ষকের কথা ঃ কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী তারিফা আক্তার জানান, এ কলেজটি একটি পরীক্ষা কেন্দ্র হয়ে গেছে। পাঠদানে শিক্ষকদের যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকলেও প্রায় ৬ মাস পরীক্ষা থাকার কারণে আমরা শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে পাঠ নিতে পারছি না। কলেজ থেকে সরকারের পরীক্ষা কমাতে হবে এবং আমাদের পাঠদানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের একজন প্রভাষক জানান, কলেজে ক্লাস থাকলে তাদেরও লাভ হয়। ছাত্রীদের ভালোভাবে পাঠ দেওয়ার স্বার্থে তারাও কিছুটা সময় পড়াশুনা করতে পারেন। কিন্তু কলেজে বছরের অধিকাংশ সময় পরীক্ষা থাকায় নিজেদের লেখাপড়ায় অলসতা এসে যায়। আর ছাত্রীদের কী পড়াবে! কলেজে বছরের বেশিরভাগ সময় পরীক্ষা থাকায় পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় শিক্ষার মানের আশানুরূপ উন্নতি হচ্ছে না বলে ছাত্রীদের অভিযোগ।
কয়েকজন ছাত্রী দৈনিক হবিগঞ্জের মুখকে জানিয়েছেন, একজন করে শিক্ষক থাকায় তারা প্রতিদিন কলেজে এসে বাংলা, ইংরেজি ও অর্থনীতি ক্লাস করে চলে যান। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, রসায়ন, ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কোন প্রভাষক না থাকার কারণে আমাদের ক্লাস না করেই চলে যেতে হয়।
কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ইষুভূষণ দাশ রায় জানান, তীব্র শিক্ষক-সংকট চলছে। বাংলা, ইংরেজিসহ কয়েকটি বিভাগে ১ জন করে শিক্ষক সংকট রয়েছে। প্রাণীবিদ্যা, ব্যবস্থাপনা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং রসায়নের প্রভাষক নেই। যে কারণে গত বছরের চেয়ে এ বছর ফলাফল একটু খারাপ হয়েছে। শিক্ষক সংকট সমাধান হলে তা আর হবে না। তিনি বলেন, শিক্ষক ছাড়াও কলেজে কর্মচারির সংকট রয়েছে। খন্ডখালীন কর্মচারি দিয়ে কলেজের কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে কলেজের অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। কলেজের নতুন আরেকটি বিল্ডিং করার জন্য ১২০ ফুট জায়গা প্রয়োজন থাকলেও কলেজের রয়েছে ১১০ফুট জায়গা। জায়গার সংকট থাকার কারণেও নতুন বিল্ডিং করা যাচ্ছে না। কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের আসন সংখ্যা রয়েছে ১শ’টি। কিন্তু পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন না থাকার কারণে ভাটি অঞ্চলের অনেক ছাত্রী কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে আসন পাচ্ছেন না। ছাত্রী হোস্টেলেও আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কলেজে বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। শিক্ষক ও ছাত্রীদের বিশুদ্ধ পানি পানের জন্য মাত্র একটি টিউবওয়েল রয়েছে। কলেজ হোস্টেল ও কলেজের আরো ২টি গভীর নলকুপ স্থাপন করা প্রয়োজন। এছাড়া কলেজের অডটরিয়াম না থাকায় কলেজের বিভিন্ন সেমিনার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে সমস্যা হয়। শ্রীঘ্রই কলেজে অনার্স চালু হবে। আর অনার্স চালু হলেই আরেকটি ভবনের প্রয়োজন হবে। তিনি কলেজের সমস্যাগুলো অচিরেই সমাধান করার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন।
এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্র কুমার শীল জানান, হবিগঞ্জের নারী শিক্ষার একমাত্র সর্বোচ্চ সরকারি বিদ্যাপীঠ নানা সমস্যায় জর্জড়িত। কলেজে ৩৪ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও বছরখানেক ধরে ১৩টি পদ খালি রয়েছে। এছাড়া অবকাঠামোগত সমস্যা, খেলার মাঠ নেই। কলেজের উপর বিভিন্ন পরীক্ষার চাপ রয়েছে। সব মিলিয়ে এ কলেজে সমস্যার শেষ নেই। তিনি বলেন, শিক্ষক সংকট নিরসনের জন্য মহা-পরিচালকের কাছে আবেদন করা হয়েছে। মহা-পরিচালক সংকট নিরসনের আশ^াস দিয়েছেন। কিন্তু কলেজ কোন ফল পাচ্ছে না। আমরা সমস্যা সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করছি।